x 
Empty Product
Wednesday, 21 February 2024 12:02

অনলাইনে জমজমাট আমের ব্যবসা

Written by 
Rate this item
(0 votes)

 রংপুরের তরুণ উদ্যোক্তা মেহেদী হাসান (২৮)। ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়েও হননি। রংপুরে ফিরে এসে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকটা শখের বশে অললাইনে আমের ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েন। একসময় স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর ওই ব্যবসায় লাভ হওয়ায় চাকরির পেছনে ছোটেননি। হয়েছেন উদ্যোক্তা। শুরুতে নিজের পৈতৃক জমির এক একরে আমের বাগান গড়ে তোলেন। মাত্র সাত বছরের মধ্যে এখন তাঁর ১৪ একরের আমের বাগান। আমের ব্যবসায় তাঁর ব্যাপক সাফল্য এসেছে।

গত কয়েক বছরে মেহেদী হাসানের মতো অনেক তরুণ উদ্যোক্তা অনলাইনে আমের ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছেন। মাত্র এক থেকে দেড় মাসের ব্যবসায় তরুণেরা বেশ ভালোই করছেন। তাঁরা এই ব্যবসা করে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন, তেমনি অন্য তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। তাঁদের পরিবারেও এসেছে সচ্ছলতা। দুই বছর আগে আমের ব্যবসায় তরুণ উদ্যোক্তা ছিলেন শতাধিক। দুই বছর পর এসে এখন ওই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন শতাধিকে।

ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ সংস্কৃতিকর্মী, আবার কেউ স্বেচ্ছাসেবী। অনলাইন ব্যবসায় তাঁদের আশা দেখাচ্ছে মৌসুমি ফল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে জমজমাট আমের ব্যবসা করছেন তাঁরা।

অনলাইনে আম বিক্রি করেন, এমন কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের খ্যাতি আছে। এই আম সুস্বাদু ও আঁশহীন। জুনের ১০ তারিখ থেকে পুরোদমে হাঁড়িভাঙা বেচাকেনা শুরু হয়েছে। আমের ব্যবসার জন্য অনলাইনের ব্যবহার ইতিমধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। অনলাইনে আম ব্যবসায় নেমেছেন তরুণেরা। শুধু রংপুরেরই তিন শতাধিক তরুণ গ্রুপ ভিত্তিতে এসব কাজ করছেন। তাঁদের আয়রোজগারও ভালোই বলে জানিয়েছেন।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এবার রংপুরে ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আম হয়েছে। গত বছর ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছিল। এবার প্রায় ২৫০ কোটি টাকার বিপণন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রংপুরের অনেক তরুণ অনলাইনে আম বিক্রির ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ এলাকায়
রংপুরের অনেক তরুণ অনলাইনে আম বিক্রির ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মেহেদী হাসানের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ এলাকায়। হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০২১ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। চাকরির পেছনে না ছুটে ২০১৫ সালে তিনি তাঁদের পৈতৃক এক একর জমির মধ্যে প্রথম হাঁড়িভাঙা আমের বাগান করেন। আয়ের টাকা দিয়ে অন্যের জমি বর্গা নিতে থাকেন। অনলাইনে আমের ব্যবসায় তাঁর ব্যাপক সাফল্য আসে। মাত্র সাত বছরের মধ্যে নিজের ৫ একর এবং সাড়ে ৯ একর অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সাড়ে ১৪ একরে আমের বাগান করেছেন। যেখানে তাঁর আমগাছ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার।

মেহেদী জানান, তাঁর বাবা সেকেন্দার আলী পেশায় কৃষক। মা পারভীন বেগম, গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। ছোট ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আমের ব্যবসা করে লাভের হিসাব টাকার অঙ্কে না বললেও তিনি বলেন, লাভ না হলে এভাবে বাগানের পর বাগান হতো না। উপার্জিত টাকা দিয়ে আরও নতুন কিছু করার ইচ্ছে আছে।

শহরের আরেক তরুণ নূর মোহাম্মদ (২৭)। তিনি ‘বিনোদন অ্যাগ্রো’ নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলে আমের ব্যবসা শুরু করেছেন। তিনি রংপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৯ সালে ডিগ্রি পাস করেছেন। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির পর থেকে উদ্যোক্তা হয়েছি। বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো। আগে অন্য টুকটাক ব্যবসা করেছি। কিন্তু সেসব ব্যবসা এখন পুরোদমে বন্ধ। দুই বছর আগে ১০ বন্ধু মিলে উদ্যোক্তা হয়ে হাঁড়িভাঙা আমের ব্যবসা করতাম। এ বছর থেকে একাই করছি।’  

নূর মোহাম্মদ আরও বলেন,  ‘দুই বছর আগে আমের ব্যবসা করে নিজের খরচ চালানোর পর পরিবারকে সহায়তা করছি। বাবা লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে হোটেল ব্যবসা করেন। অভাব–অনটনের সংসারে চার ভাইয়ের মধ্যে নূর মোহাম্মদই বড়। আম ব্যবসার উপার্জিত টাকা বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করে থাকি। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদেরও পড়াশোনার খরচ চলে।’ তিনি আরও বলেন, গত বছর কয়েকজন বন্ধু মিলে আম বিক্রি করে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যবসা হয়েছিল। এবার ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা আম বিক্রির টার্গেট করা হয়েছে।

অনলাইনে আমের ব্যবসা শুরু করেছেন আরও অনেক তরুণ। তাঁরা জানান, ভালো সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে অনলাইনে ফেসবুক পেজ দেখে আম নেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতাদের ফোন পাচ্ছেন। ক্রেতাদের কাছ থেকে ফরমাশ পেয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আম কিনে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম পাঠাচ্ছেন তাঁরা। তবে কুরিয়ারে অনেক বেশি খরচ। এটি কম হলে ব্যবসা আরও ভালো হতো বলে জানান তাঁরা।

‘আইডিয়াটিক হাঁড়িভাঙ্গা আম’ নামে ফেসবুকে পেজ খুলেছেন তরুণ উদ্যোক্তা সরকার মঞ্জুরুল মান্নান (২৮)। তিনি লেখাপড়া করেছেন গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে রসায়ন বিভাগে। চাকরির জন্য না ছুটে তিনিও হয়েছেন মৌসুমি ফল আমের ব্যবসায় উদ্যোক্তা। গত তিন বছরে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। এবার আম মৌসুমের পাঁচ দিনের মধ্যে ৭০ মণ আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছেন।  তিনি আরও জানান, এবার তাঁর ২২ থেকে ২৩ লাখ টাকা আম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি গত বছর ২১ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন।

মঞ্জুরুলের রয়েছে স্ত্রী ও এক শিশুসন্তান। স্ত্রী কারমাইকেল কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। মঞ্জুরুল মান্নান জানান, ‘যেভাবে ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছি, তাতে আমের শেষ মৌসুম পর্যন্ত দুই হাজার থেকে তিন হাজার মণ বিক্রি হতে পারে। অনলাইনে আমের ব্যবসা করে রংপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছি। আয়রোজগার ভালোই হচ্ছে।’

রংপুর উন্নয়ন ফোরাম নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে অনলাইনে আম বিক্রির একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তাদের ভাষ্যমতে, এবার তিন শতাধিক তরুণ-যুবক ও শিক্ষার্থী অনলাইনে আম ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। দুই বছর আগে এমন উদ্যোক্তা ছিলেন শতাধিক। দিন দিন উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এটি একটি ভালো দিক বলে মনে করা হচ্ছে।

অনলাইনে আমের ব্যবসার বিষয়ে রংপুর উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, শুধু যে হাঁড়িভাঙা আম তা কিন্তু নয়, বছরের মৌসুমি ফলের ব্যবসাও করছেন তাঁরা। এতে তাঁরা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। পরিবারকেও সহযোগিতা করছে।
এ বিষয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, তরুণ-যুবকদের অনলাইনে আমের ব্যবসা তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছে। এভাবেই তাঁরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন।

Read 2 times

Leave a comment

Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.