x 
Empty Product

আমের ইতিহাস-ভূগোল

User Rating:  / 1
PoorBest 

লোকায়ত জীবনের একটি আচার এ রকম বয়স্ক কুমারী মেয়েদের আইবুড়ো নাম ঘোচাতে আমগাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতো। সে জন্যই কি না আমগাছের ভেতর একটি জাঁদরেল পৌরুষভাব রয়েছে। তবে মহাকবি কালিদাস কচি

লোকায়ত জীবনের একটি আচার এ রকম বয়স্ক কুমারী মেয়েদের আইবুড়ো নাম ঘোচাতে আমগাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতো। সে জন্যই কি না আমগাছের ভেতর একটি জাঁদরেল পৌরুষভাব রয়েছে। তবে মহাকবি কালিদাস কচি

আমপাতার মরচে রং দেখে বলেছেন, ‘পার্বতীর ঠোঁটের মতো রং।’


 সংস্কৃতে আম্র, বাংলায় আম। সংস্কৃতে আরো একটি নাম রয়েছে আমের-রসাল। তবে রসাল বলতে শুধু আমই নয়, আমগাছটিও বোঝায়।
 আম অর্থ সাধারণ। সাধারণের ফল আম। যদিও দুই বছর আগে পর্যন্ত সাধারণ মানুষের নামে কোনো আমের সন্ধান জানা ছিল না, তবে সম্প্রতি মুর্শিদাবাদে বাগানের মালির নামে একটি আম পাওয়া গেছে। নাম বিমলি। ছোট আঁটির সুমিষ্টজাতের আম খেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে মালি তাঁর বউয়ের নামে নাম রেখেছেন বিমলি। এ খবর নবাব আলীবর্দী খাঁর কানে পৌঁছলে তিনি হাসিমুখে স্বাগত জানান। যাহোক, সাধারণ মানুষের নামে তাহলে একটি আমের নাম পাওয়া গেল। বাহারি নামের প্রায় হাজার জাতের আম রয়েছে আমাদের দেশে। এ ফলটির ইতিহাস-ভূগোলও অনেক কাল আগের।
 খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকেই আমাদের জনপদে আমপ্রিয় বাঙালির সন্ধান মেলে। ধারণা করা হয়, আম প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। রামায়ণ ও মহাভারতে আম্রকানন এবং আম্রকুঞ্জ শব্দের দেখা মেলে। দেবী সরস্বতীর পূজার উপকরণ হিসেবে আমের মুকুলের ব্যবহার এবং কোনো শুভ অনুষ্ঠানে আমপাতার ব্যবহার অনেককাল আগের-মাঙ্গলিক চিহ্ন।


 সংস্কৃত সাহিত্যে আম্র শব্দটি কোনো ব্যক্তি বা বস্তুও বৈশিষ্ট্য এবং সম্মান দেখানো শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যে একটি পর্বতের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ‘আম্রকুট’ নামে। ব্যাকরণবিদ পাণিনির রচনায় আম্রগুপ্ত নামের এক ব্যক্তি এবং আম্রপুর নামের একটি নগরীর বর্ণনা দেখা যায়। আম্রপাল নামের এক রাজা এবং আম্রপালি নামের ইতিহাসখ্যাত বারবণিতার পরিচয় আমাদের সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্র এবং আমগাছের সম্মান বাড়ানোর জন্য আম্রগন্ধক, আম্রনিশা, আম্রগন্ধি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যে। শৈবসাহিত্যে লিঙ্গকে বলা হয়েছে আম্রতাকেশ্বর।


 বাল্মীকির মহাকাব্য রামায়ণের অনেক শ্লোকে রয়েছে আমের কথা। সেই সময়ের লোকসাহিত্যে প্রেমার্ত হৃদয়ে আমৃমুকুলের সৌরভে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়, সেসব নিয়ে অনেক লোকগান রচিত হয়েছে আমাদের জনপদে। মহাকবি কালিদাস আম্রমুকুলকে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রণয় দেবতা সনাতন ধর্মের প্রণয় দেবতা মন্নথের পঞ্চশরের একটি শর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।


 খ্রিস্টপূর্ব ১৫০। এ সময় ভারতের সাঁচির বৌদ্ধ ভাস্কর্যে আমগাছের ছবি দেখা যায়। মহামতী গৌতম বুদ্ধ অনেক বারই আমগাছের ছায়ায় বসেছেন। ধ্যানও করেছেন। সে কারণেই বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমপাতার ব্যবহার রয়েছে। সব মিলিয়ে এ জনপদের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্যে আম অনেক পছন্দের ফল। মোগল সম্রাট বাবর হিন্দুস্তানের সর্বোৎকৃষ্ট ফল হিসেবে আমের কথা বলেছেন।


 আম খাওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি বাঙালির অনেক আগে থেকেই জানা। কাঁচা আমে কাঁচা মরিচ, আচার, চাটনি, আমসত্ত্ব আর গাভির দুধ। আহা! জিভে পানি আসার মতো স্বাদ আর কী! সম্প্রতি ইউরোপের অনেক দেশে আম থেকে ওয়াইন তৈরি হচ্ছে । আম দিয়ে তৈরি নতুন পানীয়। আমভক্তদের জন্য নতুন সংস্করণ।


 আমের জন্মস্থান কোথায়। এ নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক। রয়েছে বিকর্ত। বৈজ্ঞানিক ‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’ নামের এ ফল ভারতীয় অঞ্চলের কোথায় প্রথম দেখা গেছে, এ নিয়ে বিতর্ক শুরু। তবে আমাদের এ জনপদই আমের আদিবাস, এ সম্পর্কে আম বিজ্ঞানীরা একমত। বাংলায় আম। ইংরেজিতে ম্যাঙ্গো। মালয় এবং জাভা ভাষায় ম্যাঙ্গা। তামিল ভাষায় ম্যাংকে। চীনা ভাষায় ম্যাং-কাও।


 ইতিহাস সাী দেয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ আলেকজান্ডার সিন্ধু উপতক্যায় আম দেখে এবং খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ সময়ই আম ছড়িয়ে পড়ে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ এবং মাদাগাস্কারে। ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমচাষ হচ্ছে আফ্রিকায়। ১৬ শতাব্দীতে আম পৌঁছে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। ১৬৯০ সালে ইংল্যান্ডে কাচের ঘরে আমচাষের খবর শোনা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইয়েমেনে পৌঁছে আম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ ইতালিতে আমচাষের খবর জানা যায়।


 পর্তুগিজদের হাত ধরে জাহাজে চেপে আম যায় আমেরিকা ও ব্রাজিলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। আমাদের আমের দূর বিদেশযাত্রা। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় ব্যবসায়ীদের বগলদাবা হয়ে আম যায় মেক্সিকো। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাটিতে প্রথম আমের আঁটি থেকে গাছ হয়। আমাদের আম হয়ে গেল বিশ্ববাসীর। সাধারণ ফল এখন অসাধারণদেরও পছন্দের।


আমগাছ আমাদের জাতীয় বৃক্ষ। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় মাছ ইলিশ, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আছে জাতীয় উদ্যানও। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও আমাদেও কোনো জাতীয় বৃক্ষ ছিল না। এবার সেই অভাব ঘুচল দু’বছর আগে।


 তবে আমগাছকে জাতীয় বৃ ঘোষণার পেছনে ফল আমের অবদানই বোধ হয় বেশি। কারণ, আম খেতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি পাওয়া কঠিন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আমের পে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছে সেগুলো হলো আমগাছ দেশের বেশির ভাগ মানুষ চেনে। গ্রামে আমগাছ নেই, এমন বাড়িও খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারও বাড়িতে ১০টি গাছ থাকলে অন্তত একটি আমগাছ থাকবে। ফল সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এর কাঠ ঘর ও আসবাব তৈরিতে বেশ ব্যবহূত হয়।

Leave your comments

0
terms and condition.
  • No comments found