x 
Empty Product

গৌড় নগরীর শেষ পরিনতি

User Rating:  / 0
PoorBest 

ধনে জনে পরিপূর্ণ অপূর্ব সৌন্দর্যের ভিত্তিভূমি চির ঐশ্বর্য্যশালিনী গৌড় নগরী এক সময় সমগ্র উপমহাদেশে অত্যান্ত সুশ্রীনগরী হিসেবে রাজ্যের রাজাদের নিকট ছিল ইর্শ্বনীয়। বহু প্রাচীন কাল হতে এর সৌন্দর্যমন্ডিত উর্বর শ্যামল

ধনে জনে পরিপূর্ণ অপূর্ব সৌন্দর্যের ভিত্তিভূমি চির ঐশ্বর্য্যশালিনী গৌড় নগরী এক সময় সমগ্র উপমহাদেশে অত্যান্ত সুশ্রীনগরী হিসেবে রাজ্যের রাজাদের নিকট ছিল ইর্শ্বনীয়। বহু প্রাচীন কাল হতে এর সৌন্দর্যমন্ডিত উর্বর শ্যামল

মাটির ওপর বিদেশী শক্তির ছিল দারুন লোভ। তাই কালে কালে এ ভূখন্ডের ওপর নেমে এসেছে অভাবিত কালো থাবা। নগরের বির্ষাক্ত থাবায় সৃষ্ট ক্ষতে রক্ত জরেছে অনন্ক কাল ধরে।

সময় ও কালের পালা বদলে বিভিন্ন রাজ রাজা কর্তৃক নগরায়ন, রাজধানী রক্ষা পরিকল্পনা, অপূর্ব শৈল্পিক স্থাপত্য কলাকৌশল, সুশোভিত অট্টালিকাদী আর অনুপম প্রাকৃতিক পরিবেশ বারংবারই বহিশক্রতে আকৃষ্ট করে। এক সময় এ নগরীর তুলনা দিল্লী ছাড়া অন্য কারোর সাথে ছিল না। এ কথা অনেক ঐতিহাসিক স্কীকার করে গেছেন। বিদেশী ভ্রমনকারী পর্যাটকের কখনো লিসবন কখনো কনস্টান্টিনোপলের সাথে তুলনা করেন। আর তাই যুগ যুগ বাংলার শাসন গৌড়কে নানা নামে বিভূষিত করেছে। কখনো রামাবতি, কখনো লক্ষনাবতি, কখনো গৌড়, কখনো ফিরুজাবাদ আবার কখনো জান্নাতাবাদ সহ নানা নামে পরিচিত হয়েছে যুগে যুগে কালে কালে। তবে রাজধানী কখনো ঠান্ডা, রাজমহল, কখনো ঢাকায় স্থানান্তরিত হলেও গৌড়ের ঐতিহ্য বিলুপ্তি ঘটেনি কখনো। বরং রাজধানী যেখানেই থাক, গৌড় বঙ্গ নামটি এর সাথে যুক্ত থেকেছে বরাবরই, একথা অস্বীকার করা যায় না।

সেই ইর্শ্বনীয় চির ঐতিহ্য মন্ডিত ঐতিহাসিক গৌড় বঙ্গের রাজধানী আজ বিরাণ ভূমি। পুঁজি শুধু আজ দূর অতীত কাহিনী আর যৌলুস। আর  একে কেবল বুকে ধারণ করে মনে শিহরণ জাগায় হাজার লাখো পর্যটকদের মনে। অনেকেই আজ এর সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে শুধু বিস্ময় ও অনুভূতিই প্রকাশ করে

ক্ষান্ত।

                প্রাচীন বাংলার এ ঐতিহাসিক গৌড় নগরী নানা কারণে রাজধানীর মর্যাদা হারায়। এক পর্যায়ে পরিত্যক্ত ও  জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে বন্য পশু-পক্ষির সু-আবাস স্থলে রূপান্তরিত হয়।

                 এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলির ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন, সে সাথে রাজ্যে অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন গৌড় নগরী ধ্বংসের  অন্যতম কারণ। বারংবার রাজধানী স্থানান্তর, বহিশক্রর আক্রমন ও নগরী লুটপাটও অনেকাংশে দায়ী। প্রাচীন অট্টালিকাদি, জল ও পয়নিস্কাসন ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মহামারী এবং ভূমিকম্পও বহুলাংশে দায়ী। সর্বপরি ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ হতে বিচার ও একে রক্ষার প্রচেষ্টা গ্রহণ না করে আবাসগৃহ অট্টলিকাগুলি উপকরণাদী, মূল্যবান সম্পদের ব্যাপক লুটতরাজ ঐতিহাসিক গৌড় নগরীকে ধ্বংস ও বিরাণভূমি হবার পথকে সুপ্রশস্থ এবং দ্রুত ত্বরান্বিত করে।

এ অঞ্চলের নদীগুলির ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তনের কথা এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। কাজেই এ নিয়ে বেশী আলোচনা সংগত নয়। তবে রাজধানী স্থানান্তর সম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।

পাল শাসনামলের রমাবতি যে গৌড়েই ছিল তা সন্দেহাতীত বিষয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের লেখা তথ্য উপাত্ত হতেই তা বেরিয়ে এসেছে। তবে একবারেই সুস্পষ্ট ইংগিত ইতিহাসে অদ্যাবধি প্রদান করে যায়নি। তমাসাচ্ছন্ন থেকেই গেছে খানিকটা। পাল রাজাদের রাজধানী কোথায় ছিল তাও অদ্যাবধি অস্পষ্ট। চতুর্দশ রাজা রামপালের (১০৯১-১১০৩) আমলে গৌড়ের যে অংশ রামাবতি নামকরণ করা হয় তােিক রাজধানী চিল নাকি সনামধন্য শহর ছিল এ নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে আজো। পাল রাজাদের রাজধানীর নাম না পাওয়া গেলেও “জয়স্কন্ধাবার” শব্দটি শোনা যায়। বোধ হয় দূর অতীতে সেই পাল বৌদ্ধ রাজারা জয়স্কন্ধাবারকেই খানিকটা রাজধানীর মর্যাদা দিতেন।

পাল বংশীয় ২য় বৌদ্ধ রাজা রাম ধর্মপাল দেবের (৭৮৫-৮২০ খ্রি.)রাজা শাসনের ৩২তম বর্সে উৎকীর্ণ ভূমি দান সংক্রান্ত ভোলাহাট উপজেলা হতে প্রাপ্ত একমাত্র তা¤্রলিপি ১৩তম শ্লোকের পর গদ্যাংশে সংস্কৃত ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে।“নানাবিধ নৌবাটসস্পাব্দিতসেতু বন্ধ নিহিত” অর্থাৎ নানা প্রকার (রাজ্য) রণতরী  (নৌবাটক) সুবিখ্যাত। যা সেই সময়ে প্রবাহমান ভাগীরথী নদীদে সুসজ্জিত থাকতো। এ তথ্য হতে প্রতিয়মান হয় যে,ধর্মপ্রালদেবের শাসনামলে এখানে বিরাট সুসজ্জিত নৌ ঘাঁটি ছিল। সে সময়ে রাজার জয়স্কন্ধাবার হয়তো এই গৌড়ের আশপাশেই কোথাও ছিল না। রাজা বল্লাল সেনের পুত্র রাজা রায় লখমনিয়া (১১৬৯-১২০৩) বা লক্ষণ সেন গৌড় বঙ্গ শাসন করতেন। তিনি গৌড়কে নিজের নামানুসারে লক্ষণাবতী নামে আখ্যায়িত করেন। আবিদ আলী খান “রমাবতী ও লক্ষণাবতী নামে পরিচিত গৌড় সম্ভবতঃ পাল ও সেন রাজাদের রাজধাণী সমূহের অন্যতম ছিল বলে মন্তব্য করেন।” ১২০২ খ্রি. ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বঙ্গ বিজয়ের পরে মসজিদ, মাদ্রাসা ও সরাইখানা প্রতিষ্ঠা ও লক্ষণাবতীকে লখনৌতি নামকরণের মধ্য দিয়ে তার প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ইকতিয়ারউদ্দিন মোহম্মদ বিন বখতিয়া খজলী থেকে কদর খান পর্যন্ত রাজ প্রতিনিধিগন লকনৌতিতে রাজধানী বহাল রাখেন। ১৩৩৮ খ্রি. পরবর্তী ১৪ বছরের মধ্যে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ দেশেটিকে তার শাসনাধীনে এনে লখনৌতি থেকে ২০ মাইল উত্তর পূর্ব দিকস্থ প্রাচীন হিন্দুনগর পান্ডুয়াকে (ফিরোজাবাদ) মুসলিম বাংলার রাজধানী পরিণত করেন।

রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার একটিই কারণ যে নদীর গতিপথ পরিবর্তন। এর ফলে লখনৌতি অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গৃহ যুদ্ধ ও নগরটির ক্রমাগত লুণ্ঠন, রাজধানী স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করে। ১৪৪২-১৪৫৯ খ্রিঃ স¤ভবত নাসিরুদ্দিন আবুল  মুজাফফর মাহমুদের শাসনামলে ফিরোজাবাদ হতে গৌড়ে রাজধানী পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। এ স্থানান্তরের কারণও নদীর খাত পরিবর্তন। গঙ্গ নদী  শহরের  পশ্চিম দিকে স্থিতিশীল গতিপথ প্রবাহমান হয়। ৯৮৫ হিজরী সনে (১৫৩৮ মতান্তে ১৫৩৯ খ্রিঃ) সম্রাটবাবরের ছেলে হুমায়ুন  বাংলায় আসেন। গৌড়ের সঙ্গে কবরের  (গোরের) নাম সামঞ্জস্যপূর্ণ থকায় এবং গৌড় নগরীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিন মাস এ স্থানে অবস্থান করতঃ গৌড় নাম পরিত্যগ করে এর নাম দেন জান্নাতাবাদ। এম আবিদ আলী খানের মতে ১৫৩৯ খ্রিঃ শেরশাহ যখন বাংলা আক্রমন করেন, তখন গৌড় লুণ্ঠিত হয়। বাংলা পিডিয়ার মতে (১৫৩৮খ্রিঃ) ফরিদউদ্দিন শেরশাহ্ কর্তৃক গৌড় বিজয় ও মহর লুণ্ঠিত হয়। গৌড়ের ইুতহাস প্রণেতা রজনী বাবুর মতে শেরশাহ্ ১৫৩৭ খ্রিঃ শহর লুণ্ঠত করেন্ ১৫৬৪ মতান্তে ১৫৬৫ খ্রিঃ (৯৭২হিঃ) সোলায়মান করবানী দূষিত আবহাওয়ার কারণে গৌড় নগরী পরিত্যাগ করে তান্ডায় (টান্ডা বা টাঁড়া) রাজধানী স্থাপন করেন। আকবরের প্রথম রাজ প্রতিনিধি মুনিম খান-খান-ই-খানান ১৫৭৫ খ্রিঃ পুনরায় তান্ডা হতে রাজধানী গৌড়ে স্থানান্তরিত করেন। সে বছর বর্ষাকালে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে। সে সময়েই তাড়াহুড়ো করে পুনরায় রাজধানী তান্ডায় ফিরিয়ে নেয়া হয়া। এভাবে রাজধানী বারংবার স্থানান্তরিত করাকে স্থানীয় অধিবাসীরা টাঁড়সে আর গৌড়সে বলে একটি উপকথার প্রচলন করে। বর্তমানে কোন বস্তুকে এক স্থান হতে অন্য স্থানে বারবার টানাটানি বা স্থানান্তর (ঐ আদি কালের ইতিহাস ধরে) করলে বিরক্ত হয়ে “টাঁড়সে আর গৌড়সে” কথাটি উচ্চারণ করে। এটি একটি উপকথায় রূপ নিয়েছে। গ্রাম অঞ্চলের মানুষেরা বিশেষতঃ ভোলাহাট উপজেলা মহিলারা উপকথা হিসেবে এটিকে বেশী। ব্যবহার করে থাকে। উপকথাটি আজো প্রচলিত।

১৫৯৫ খ্রিঃ সম্রাটআকবরের শাসনামলে রাজা মানসিংহ রজিধানী তান্ডা হতে গঙ্গা ৎনদীর অপর পাড়ে রাজমহল সরিয়ে নেন। এ রাজধানীর নতুন নামকরন হয় আকবরাবাদ। এ স্থানান্তরের কারণেই হচ্ছে পুনরায় নদঅর গতিপথ পরিবর্তন। ১৮২৬ খ্রিঃ প্রাচীন বাংলার রাজধানী তান্ডা বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার সুবাদার ইসলাম খান ১৬১২ খ্রিঃ রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। এ সময় নতুন নামকরন করা হয় জাহাঙ্গীর নগর। বাদশাহ্ শাহজাহানের রাজত্বকালে বাংলার রাজ প্রতিনিধি শাহাজানা শাহ্ সূজা ১৬৩৯ খ্রিঃ পুনরায় রাজধানী ঢাকা হতে রাজমহল স্থানান্তরিত করেন। বাদশাহ্ আওরংজেবের শাসনামলে বাংলার প্রথম গভর্ণর মীর জুলমা ১৬৬০ খ্রিঃ আবার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্ত ১৭০৪ সালে মূশিদ কুলি খান মুকসুদাবাদকে মর্শিদাবাদ নামকরণ করে। বাংলা উড়িষ্যার রাজধানী হিসেবে স্থানাস্তরিত করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর কলিকাতা চুড়ান্তভাবে বাংলার রাজধানীতে রুপান্তরিত হয়। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ভারতের রাজধানী হিসেবে কলিকাতা টিকে থাকে।১৮৯৭ খ্রি. এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাচীন গৌড় নগরীর অনেক ঐতিহ্যমন্ডিত সুউচ্চ ইমারত বিধ্বস্থ হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ছোট সোনা মসজিদ অন্যতম। এ সময় ঐ মসজিদেও পশ্চিম দিকের পাথর, দক্ষিণ পশ্চিমের গম্বুজও বিধ্বস্থ হয় বলে ইতহাস সাক্ষ্য দেয়।

Leave your comments

0
terms and condition.
  • No comments found