x 
Empty Product

আমের দেশে পর্যটন (ভিডিও)

User Rating:  / 2
PoorBest 

প্রাচীনকালে এই এলাকা গৌড় নগরীর আওতাভূক্ত ছিল। গৌড়ের সেই স্বর্ণযুগে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে নানার স্থাপত্য নিদর্শন। যার মধ্যে মসজিদই প্রধান। সেই প্রাচীনকালে নির্মিত নিদর্শনগুলো আজ অযত্ন অবহেলায় প্রায়

প্রাচীনকালে এই এলাকা গৌড় নগরীর আওতাভূক্ত ছিল। গৌড়ের সেই স্বর্ণযুগে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে নানার স্থাপত্য নিদর্শন। যার মধ্যে মসজিদই প্রধান। সেই প্রাচীনকালে নির্মিত নিদর্শনগুলো আজ অযত্ন অবহেলায় প্রায়

ধ্বংসের মুখোমুখি। অনেকগুলো ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে, অন্যগুলোর অবস্থাও করুণ।

প্রাচীন নিদর্শন সমূহঃ
ঐতিহ্যবাহী ছোট সোনা মসজিদ (নির্মাণকাল ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ)
তোহাখানা মসজিদ ও শাহ্‌ সুজার কাছারীবাড়ী (নির্মাণকাল ১৬৩৯-১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দ)
চাঁপাই জামে মসজিদ (নির্মাণকাল ৮৯৩ হিজরী)
দারসবাড়ী মসজিদ ও মাদ্রাসার ধংসাবশেষ (নির্মাণকাল ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দ)
দাখিল দারওয়াজা (নির্মাণকাল ১২২৯ খ্রিস্টাব্দ)
হযরত শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌ (রঃ) সাহেবের মাজার (নির্মাণকাল ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দ)
মহারাজপুর মসজিদ (নির্মাণকাল মোঘল আমল)
শাহাবাজপুর বালুয়া দীঘি (খননকাল ১১৫৮-১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ)
নওদার স্তুপ বা ষাঢ় বুরুজ (সম্ভাব্য ১১৭৯-১২০৫ খ্রিস্টাব্দ)
এছাড়াও নসরত শাহের টাকশাল দীঘি, ধনাইচকের মসজিদ, খঞ্জন দীঘির মসজিদ, হোসেন ভিটা, নাধাইয়ের জমিদার বাড়ীর ধংসাবশেষ, নাচোল রাজবাড়ী, হাটের সেন আমলের পুরাকীর্তি, কানসাটের জমিদারবাড়ী, মকররমপুরের বল্লাল সেন নির্মিত শ্মশানবাড়ীর ধংসাবশেষ (নির্মাণকাল ১১৫৮-১১৭৯ খৃস্টাব্দ)।

ছোট সোনামসজিদ :
 জেলার পশ্চিম সীমান্তে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজাস্থিত ছোট সোনামসজিদটি সুলতানী আমলের স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। এর কারুকার্য অপরূপ। গঠনভঙ্গি বৈচিত্রময় এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মসজিদের গম্বুজগুলির মধ্যস্থলে কেন্দ্রীয় গম্বুজ হিসেবে বাংলাদেশে প্রচলিত চৌচালা বাড়ির চালের মতো পরস্পর তিনটি গম্বুজ সংযোজিত রয়েছে। এছাড়া দুই সারিতে ৩টি করে দুই পার্শ্বে আরো ১২টি গোলাকৃতি গম্বুজ - মোট ১৪টি গম্বুজ মসজিদের অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। এই মসজিদের আভ্যন্তর গৌড়ের আদিনা মসজিদের কক্ষের অনুরূপ। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে (সম্ভবত মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য) একটি স্বতন্ত্র ছাদ বা মঞ্চ প্রস্তর স্তম্ভের উপর স্থাপিত রয়েছে এবং সেখানে গমনাগমনের জন্য উত্তর দেওয়ালে একটি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি সংলগ্ন একটি মিনারও রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য। ভেতরের ওই ছাদটির একটি প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরিত হয়ে নিকটস্থ হযরত শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌র সমাধি প্রাঙ্গণে নীত হয়েছে। মসজিদে কারুকার্য খচিত একটি মেহরাব রয়েছে।
 
এই মসজিদটি দৈর্ঘ ৮২ ও প্রস্থ ৫২ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং এর চার পার্শে অষ্টকোণ বিশিষ্ট সুউচ্চ চারটি বুরুজ আছে। মসজিদটি মূলত ইটের ইমারত হলেও দেওয়ালের বাইরের অংশ পাথর আবৃত। ভিতরের দেয়ালও অনেকাংশে পাথর আবৃত। সামনের দেওয়ালে সমমাপের ৫টি দরজা রয়েছে। এছাড়া মসজিদের গায়ে নানা প্রকার লতাপাতার কারুকার্য তো আছেই। মধ্যবর্তি দরজার চারপাশের কারুকাজ অধিকাংশই পাথরে খোদিত। স্থানীয় লোকেরা গৌড়ের বড় সোনামসজিদের সংগে তুলনা করে একে ‘ছোট সোনামসজিদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ঐতিহাসিক জেনারেল ক্যানিংহামের মতে, কিছ সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী এই মসজিদের সাজ-সজ্জার পরিকল্পনা বা নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে এ গম্বুজগুলি সোনালী রং-এ গিল্ট করা হলে এটি সোনা মসজিদ নামে অভিহিত হয়।

বংগের গৌরবময় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খৃস্টাব্দ) ৮৯৯ হতে ৯২৫ হিজরীর মধ্যে জনৈক আলীর পুত্র ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক রজব মাসের ১৪ তারিখে ছোট সোনামসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদের সম্মুখবর্তী কারুকার্য খচিত দরজার উপরের অংশের একটি পাথরে উৎকীর্ণ আরবী শিলালিপি থেকে একথা অবগত হওয়া যায়। মসজিদের আভ্যন্তরের আয়তন ৭১ ফুট ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৪০ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ। ৩ সারিতে বিভক্ত। প্রত্যেক সারিতে ৫টি করে পাথরে স্তম্ভ রয়েছে। কতটা গোলাকৃতি অথচ একটু লম্বা ৫টি মেহরাব আছে। কিন্তু মেহরাবের কারুকার্য খচিত শ্বেত পাথরগুলো বর্তমানে নেই। স্থানীয় জনশ্রুতি ও কয়েকটি বিবরণীতে জানা যায় যে, ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের বহুলাংশ ভেঙ্গে পড়ে। ১৯০০ সালে তা কেবলমাত্র ইট দ্বারা মেরামত করা হয়। এসময় মেহরাবের উপরে স্বতন্ত্র শ্বেত পাথরের একখণ্ড উজ্জ্বল বস্তু ও আরো কয়েক টুকরো পাথর খণ্ড ইংরেজরা বিদেশে নিয়ে যায়। এমনকি পশ্চিম দেওয়ালের কারুকার্যপূর্ণ কতগুলো দুষ্প্রাপ্য ও বহুমূল্যবান শিল্পনিদর্শনও স্থানান্তরিত হয়ে বিলেতে চলে যায়।

জনশ্রুতি আছে-
 * মসজিদের সামনের প্রবেশ পথে যে একটি বিরাট ইট নির্মিত তোরণের অবশিষ্টাংশ রয়েছে, ভূমিকম্পের আগে তার সর্বাঙ্গে বিবিধ রং-এর পাথরখণ্ডে অলংকৃত ছিল।

* বেনারস থেকে আগত শিল্পীদের দ্বারা এই মসজিদের কারুকার্য সম্পাদিত হয়েছিল।

* মসজিদের পূর্ব উত্তর কোণে মঞ্চাবস্থায় পরস্পর সন্নিহিত যে দুটি পাথর নির্মিত অজ্ঞাত মসাধি (দৈর্ঘ ১৫ ফুট ও প্রস্থ সাড়ে ১০ ফুট) রয়েছে তা একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা ও আরেকটি নাকি তার আত্মীয়ের সমাধি। মতান্তরে এই দু’টি কাল্পনিক কবর বরং মসজিদ প্রতিষ্ঠাতার কিছু গুপ্তধন রতি রয়েছে।

* “এক প্রহর বেলা পর্যন্ত সোনা বর্ষিত হয়েছিল মতান্তরে প্রচুর সোনা পাওয়া গেছে- সেজন্য স্বর্ণপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক এখানে দীঘি খনন ও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে ‘সোনামসজিদ নামকরণ হয়েছে।”

ছোট সোনামসজিদের প্রস্তরলিপিঃ

দরজাগুলোর প্রান্তদেশ বলিষ্ঠ শোভাবর্ধক রেখা দিয়ে ঘেরা। কিস্তু খোদাই কাজটি অগভীর এবঙ অট্টালিকার খুব নিকটে না পৌছলে এ খোদাই কাজ চোখে পড়ে না। দরজাগুলোর মধ্যবর্তী কুলুঙ্গীগুলোতেও এই একই অগভীর খোদাই কাজ ছড়িয়ে আছে।

মধ্য দ্বারটির উপরিভাগে যে লিপি প্রস্তুরটি রাখা আছে তার উপরের ডানদিকের কোণা ও নিচের বাম দিকের কোণা - এই উভয় কোণাই হারিয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু রাজার (হোসেন শাহ্‌) নামটা দেয়া আছে এজন্য আমরা জানি যে, এটা ১৪৯৩-১৫১৯ সালে নির্মিত হয়েছিল। (হিজরী ৮৯৯-৯২৫ এর মধ্যবর্তী সময়ে)

মধ্যম দ্বারের উপরস্থ এই লিপিটির অনুবাদঃ 'দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহ্‌র নামে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, যে আল্লাহর ও বিচার দিনের উপর বিশ্বাস করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, ভিক্ষা প্রদান করে এবঙ আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করেনা সে নিশ্চয় আল্লাহর মসজিদ তৈরী করবে এবং তারা শীঘ্রই পথ প্রদর্শিতদের অন্তর্ভূক্ত হবে।' এবঙ নবী,- তাঁর উপর আল্লাহ্‌র রহমত বর্ষিত হোক। বলেন যে, আল্লাহর জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য অনুরূপ একটি গৃহ বেহেস্তে তৈরী করা হবে। এই মসজিদের নির্মাণ কার্য সুলতানগণের সুলতান, সৈয়দগণের সৈয়দ, পবিত্রতার উৎস, যিনি মুসলমান নরনারীর উপর দয়া করেন, যিনি সত্য কথা ও সৎকাজের প্রশংসা করেন, যিনি সর্বোচ্চ বিচারকের সাহায্যে সহায়তা প্রাপ্ত হন, যিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর পথে সচেষ্ট থাকেন, যিনি কাজে ও প্রমাণে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষক, সেই আলাউদ্দুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুযাফফর হোসেন শাহী সুলতান আল হোসাইনী, -আল্লাহ তাঁর রাজ্য ও শাসন চিরস্থায়ী করুন। -এর রাজত্বকালে সংঘটিত হয়। খালেস ও আন্তরিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস রেখে ওয়ালী মোহাম্মদ পিতা আলী (যার উপাধি হচ্ছে) মজলিস-উল-মাজালিস মজলিস মনসুর, কর্তৃক জামে মসজিদ নির্মিত হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানে তাকে সাহায্য করুন। এর শুভারম্ভ তারিখ হচ্ছে আল্লাহর রহমতের মাস রজবের ১৪ তারিখ। এর মূল্য ও মর্যাদা বর্ধিত হোক।"

এই শিলালিপিটির মধ্য লাইনে তিনটি শোভাবর্ধক বৃত্ত রয়েছে। প্রত্যেকটির মধ্যে রয়েছে আল্লাহ্‌র নাম। মধ্যম বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে, 'ইয়া আল্লাহ্‌' (ও আল্লাহ্‌), 'ডানদিকের বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে 'ইয়া হাফিয' (ও রক্ষক) এবং বামদিকের বৃত্তটির মধ্যে 'ইয়া রহিম' (ও দয়াময়)।


শাহ্‌ নেয়ামতুলাহ (রঃ) ও তাঁর মাজার:
নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে (গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে) ইসলাম বিস্তৃতির দায়িত্ব যাঁরা বহন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে স্বনামে খ্যাত সাধক হযরত শাহ্‌ সৈয়দ নেয়ামত উলাহ্‌ (রঃ) অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
 সুলতান শাহ্‌ সুজার রাজত্বকালে (১৬৩৯-১৬৬০ খৃস্টাব্দ) তিনি দিল্লী প্রদেশের করো নিয়ার নামক স্থান থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নানা স্থান ভ্রমণ করে রাজমহলে এসে উপস্থিত হন। তাঁর আগমনবার্তা জানতে পেরে সুলতান সুজা তাকে সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁর হাতে বায়াত হন। পরে তিনি গৌড়ের উপকন্ঠে (শিবগঞ্জ থানার) ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন। দীর্ঘদিন এতদঞ্চলে তিনি সুনামের সঙ্গে ইসলাম প্রচার করে ফিরোজপুরেই ১০৭৫ হিজরী (১৬৬৪ খৃস্টাব্দে) মতান্তরে ১০৮০ হিজরীতে (১৬৬৯ খৃস্টাব্দে) সমাধিস্থ হন।

পারস্য দেশীয় একটি বিবরণীতে হযরত শাহ্‌ নেয়ামতুল্লা (রহঃ) সম্পর্কে কিছু আলোকপাত রয়েছে। তিনি একজন জবরদস্ত আলেম ও আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ আউলিয়াগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। শিবগঞ্জ থানার তোহাখানা প্রাসাদিটি সুলতান শাহ্‌ সুজা শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহর বাসের জন্য প্রদান করেন। পরে তিনি সেখানে একটি ৩ গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। যা এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং স্থানীয় লোকেরা নামাজ আদায় করেন।

শাহ্‌ নেয়ামউল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বংশধর ও পুরুষাণুক্রমিক ওলী ছিলেন। তিনি হাতিকাত ও মারেফাতের শ্রেষ্ঠ কামেল দরবেশ ছিলেন। তাঁর মত একজন ধর্মনিষ্ঠ আউলিয়া আজীবন যাতে নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম ও মুসলমানের সেবা করতে পারেন এবঙ উত্তরোত্তর রাজ্যের তরক্কী কামনা করতে পারেন - সেজন্য বাদশাহ্‌ আলমগীর মহি-উদ-দীন আওরঙ্গজেব সুবায়ে বাঙলা সরকার জান্নাতাবাদ পরগণে 'দারাশাকে' ৫,০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি মদদমাসা স্বরূপ তাঁর ও তাঁর বংশাবলীর ভরণ পোষণের জন্য দান করেন। তিনি প্রায় ৩৩ বছর যাবত এই সম্পত্তির আয় থেকে এই মসজিদ ো খানকার যাবতীয় খরচাদি নির্বাহ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরও বহুদিন পর্যন্ত উত্ত সম্পত্তির আয় হতে খানকা ও মসজিদের ব্যয় হতো।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানটি নিম্নরূপঃ

"যেহেতু (সুলতানের) উদার ও ধার্মিক অন্তরে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং নবীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাঈদদের আকাঙ্খা ও ইচ্ছা পূরণের অভিলাষ গভীরভাবে বদ্ধমূল, সেজন্য এই শুভ সময়ে সাঈদ ও আমীরবৃন্দের এবং যারা হাকিকাত ও মারিফাতের (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) সাথে সুপরিচিত তাদের আশ্রয়স্থল শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌র প্রতি রাজকীয় দানশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণ ও দয়ার আশ্রয় থেকে এই মর্মে একটি মহান ফরমান জারী করা হয়েছে যে, শরৎকালীন ফসলের শুরু থেকে বাংলা সুবার (প্রদেশ) জান্নাতাবাদ সরকারের দরসড়ক পরগনা থেকে ৫০০০/- টাকা তাঁর বংশধরগণের ভরণপোষণের জন্য মঞ্জুর করা হোক। যাতে তিনি আরাম আয়েশে জীবন যাপন করতে পারেন এবং সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধর জন্য প্রার্থনা করতে পারেন।
 সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ এই রাজকীয় আদে স্থায়ী বিবেচনা করবেন। এবং যে পরগনার সে সব মৌজার আয় ৫,০০০ টাকা সেগুলো তাঁর ভরণপোষণের নিমিত্তে হস্তান্তর করতে হবে। পরলোকগত সুলতানের একটি সাবের ফরমান দ্বারা দরবেশকে যে মদদ-ই-মাশের (খরচ) মঞ্জুরী দেয়া হয়েছিল, উপরোক্ত অর্থ এর অতিরিক্ত বিবেচনা করতে হবে। ফরমানের মধ্যে উল্লেখ নেই এমন কিছু (অর্থাৎ মঞ্জুরী) বাতিল বলে গণ্য করতে হবে।”
 মূল ফরমানটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু ফরমানটি যা রবিউস সানি ১০৭৭ হিজরীতে পালিত হয়েছে বলে সম্রাটকে জানানো হয় এবং শাজাহানের ১৬ই রবিউসসানি, ১৪৪৩ হিজরী তারিখে পূর্বতন ফরমানটি এই উভয় ফরমানের সত্যায়িত অনুলিপি মালদহ কালেকটরেটে পাওয়া যায়। গৌড়ের ফিরোজপুরে যে ৪০০ বিঘা পতিত জমি সৈয়দ শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌ চাষের অধীনে এনেছিলেন এবং যার আয় থেকে তিনি সেখানে তাঁর নির্মিত একটি মসজিদ ও খানকার ব্যয় নির্বাহ করতেন, পূর্বতন আদেশটি দ্বারা তাঁর উপর যে কোন ধরণের কর আরোপ নিষিদ্ধ করা হয়। ফরমান দু’টির তারিখ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, দরবেশ অন্তত ৩৩ বছর ফিরোজপুরে বসবাস করেন এবং তাঁর মৃত্যুর তারিখ হিসেবে ১০৮০ হিজরীকে ধরা হয়।

শাহ্‌ নেয়ামত উলাহ্‌ (রঃ)-র সমাধি:
 বারোদুয়ারীঃ হযরত শাহ্‌ নেয়ামত উলাহ্‌ (রঃ)-র মাযার শিবগঞ্জ থানার তোহাখানায় অবস্থিত (ছোট সোনোমসজিদ থেকে কিছু দূরে)। বারো দরোয়াজা বিশিষ্ট চতুস্কোণায়ত তাঁর সমাধিটি ‍"বারোদুয়ারী" নামে প্রসিদ্ধ। প্রত্যেক ধারে ২/৩টি করে দরোয়াজা আছে। এই বারোদুয়ারীতে যে লিপিটি রয়েছে তা হোসেন শাহী যুগের একটি আরবী লিপি, পরবর্তীকালে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে।
 6QRAhKRCko4">6QRAhKRCko4" type="application/x-shockwave-flash" allowfullscreen="true" width="540" height="400">
শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌র সমাধি প্রাঙ্গণে বারবাক শাহের রাজত্বকালে আর একটি শিলালিপি ‌'শিলা-উল-মুতাখিরিণের' প্রণেতা মীর গোলাম হোসেনের সমাধিতে ভুলক্রমে স্থাপন করা হয়েছে। এই সমাধি প্রাং্গণে আরো কয়েকজন সাধক পুরুষের সমাধি রয়েছে। এই সমাধিপ্রাঙ্গন বৃক্ষশোভিত ও ইটের প্রাচীর বেষ্টিত।

তিন গম্বুজ মসজিদ ও তোহাখানা:
শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুরস্থিত শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌ (রঃ) প্রতিষ্ঠিত তদীয়সমাধি সংশ্লিষ্ট তিন গম্বুজ জুম'য়া মসজিদ মোঘাল যুগের একটি বিশিষ্ট কীর্তি। এতে ৩টি প্রবেশপথ এবং ভেতরে ৩টি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের ভেতর ও বাইরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কারুকার্য নেই। দেয়ালে কয়েকটি তাক আছে। স্থানীয় জনসাধারণ এই মসজিদে নিয়মিতভাবে জুম’য়া নামাজ আদায় করে থাকেন।

এই মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে সুলতান শাহ্‌ সুজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বিতল ইমারতটির ভগ্নাবশেষ মোঘলযুগের আর একটি কীর্তি। এই ইট নির্মিত ইমারতটি 'তোহাখানা' নামে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে যে, বঙ্গ যুগের সুলতান শাহ্‌ সুজা তাঁর মোরশেদ হযরত শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে (রাজত্বকাল ১৬৩৯-৫৮ খৃস্টাব্দ) শীতকালীন বাসের জন্য ‌'তাপ নিয়ন্ত্রণ' ইমারত হিসাবে এ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে শাহ্‌ সুজাও এখানে এসে বাস করতেন। ইহার দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে ১১৬ফুট এবঙ প্রস্থে ৩৮ ফুট। এতে ছোট বড় অনেক কামরা উভয় পাশে বারান্দা ছিল। গৌড়ের প্রাচীন কীর্তির মধ্যে এই শ্রেণীর ইমারত এই একটিই পরিলক্ষিত হয়। কড়িকাঠের উপরে খোয়া ঢালাই করে যার ছাদ ও কোঠা জমাট করা হয়েছে।

উল্লেখিত মসজিদ ও তোহাখানা, সরোবর 'দাফেউল বালাহ'র তীরে অবস্থিত। এই দুই ইমারত হতে সিঁড়ি সরোবরের তলদেশ পর্যন্ত বিনস্ত। পূর্বতীর হতে উক্ত ইমারতদ্বয়ের দৃশ্যাবলী খুবই মনোরম।

দাফেউল বালা:
  তোহাখানা সংলগ্ন জলাশয়টির নাম ‘দাফেউল বালা’। এটি খুবই মাহাত্মপূর্ণ জায়গা। কথিত আছে খাস মনে এর পানি পান করলে যে কোন পীড়া সেরে যায়। এজন্য এ পুকুরের পানি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সবার নিকট পবিত্র। রোগ-ব্যাধি মুক্ত হওয়ার জন্য বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান এর পানি ব্যবহার করেন। বিশেষত ওরশের সময় এ পানি নেয়ার জন্য হাজার হাজার লোকের ভিড় হয়ে থাকে।
 কথিত আছে শাহ্‌ নেয়ামত উল্লাহ্‌র সময়ে কোন কারণে এর পানি নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ কিংবা অন্য কোন পশু বা জীব-জন' এ পানি পান করলেই মারা যেত। শাহ্‌ সাহেব কয়েকজন মুরীদসহ এখানে উপসি'ত হন এবং সকলে মিলে পুকুরের পানি পান করেন। সঙ্গে সঙ্গে পানি ভাল হয়ে যায়।
 মতান-রে এ সম্পর্কে প্রচলিত আছে। হযরতের ঈমান পরীক্ষার জন্য যখন বাদশাহ্‌ তাঁকে এক গ্লাস বিশাক্ত শরবত পান করতে দেন তখন সকলেই তাঁকে বাধা দেন। বিরক্ত হয়ে তিনি স্বয়ং অর্ধেক শরবত পান করেন বাকি অর্ধেক এই পুকুরে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠে। হযরত কেরামতী বলে সবকে বাঁচান এবং এ পানি বিষমুক্ত করে পানের উপযোগী করেন। এ মধ্যে ঐতিহাসিক সত কিছু আছে কিনা ঠিকভাবে বলা যায় না। কেউ কেউ মনে করেন বাদশা স্বয়ং শরবতে তোহুরা পান করতেন। তিনি তাঁর কণ্যাকে পাত্রস' করার জন্য মনে মনে তাঁর নিজের চেয়ে বেশী ঈমানদার লোক খুঁজছিলেন, তাই নতুন অতিথিকে এ শরবত পান করতে দিতেন। অনেকেই সহ্য করতে না পেরে, শরবত পানের সঙ্গে মারা যেতেন।

দারসবাড়ী মসজিদ:

কোতোয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে দারসবাড়ী অবসি'ত। পুরুষানুক্রমে স্থানীয় জনসাধারণ এই স্থানকে দারসবাড়ী বলে থাকেন। বর্তমানে এই স্থানে দারস-এর কোন ব্যবস্থা নেই। দারস অর্থ পাঠ। বোধহয় এক সময় মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা ছিল এখানে। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের সময় মুন্সী এলাহী বকস কর্তৃক আবিষ্কৃত একটি আরবী শিলালিপি (লিপি দৈর্ঘ্য ১১ ফুট ৩ইঞ্চি, প্রস্থ ২ফুট ১ ইঞ্চি) অনুযায়ী ১৪৭৯ খৃস্টাব্দে (হিজরী ৮৮৪) সুলতান শামস্‌ উদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তাঁরই আদেশক্রমে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইট দ্বারা নির্মিত এই মসজিদ আভ্যন-র দুই অংশে বিভক্ত। যার আয়তন ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি গুনিত ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। পূব পার্শ্বে একটি বারান্দা, যা ১০ ফুট ৭ ইঞ্চি। বারান্দার খিলানে ৭টি প্রস-র স-ম্ভের উপরে ৬টি গম্বুজ এবং মধ্যবর্তিটি অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। উপরে ৯টি গম্বুজের চি‎ন্‌হাবশেষ রয়েছে। উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য প্রস-র স-ম্ভের উপর একটি ছাদ ছিল। এর পরিচয় স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে। এতদ্ব্যতীত পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব বর্তমান রয়েছে। এই মসজিদের চারিপার্শ্বের দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এ মসজিদটিও বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের কীর্তির একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এখানে প্রাপ্ত তোগরা অক্ষরে উৎকীর্ণ ইউসুফ শাহী লিপিটি এখন কোলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। জেনারেল ক্যানিংহাম তাঁর নিজের ভাষাতে একে দারসবাড়ী বা কলেজ বলেছেন। এ ঐতিহাসিক কীর্তির মাত্র কয়েক গজ দূরে ভারতীয় সীমান্ত।

খঞ্জন দীঘির মসজিদ:
দারসবাড়ী মসজিদের দক্ষিণ দিকে বল্লাল সেন খননকৃত বালিয়া দীঘির দক্ষিণ পাড় ঘেঁসে পূর্বদিকে কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ে খঞ্জন দীঘির মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এক প্রাচীন জলাশয়ের পাশেই এ ধ্বংসাবশেষটি অবসি'ত। খঞ্জন দীঘির মসজিদটি অনেকের নিকট ‘খনিয়া দীঘির মসজিদ’ নামে পরিচিত। অনেকে আবার একে রাজবিবি মসজিদও বলে থাকেন।

বহুকাল ধরে মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর অজানাভাবে পড়িছিল। জঙ্গল কমে গেলে মসজিদটি মানুষের চোখে পড়ে। কিন' ইতোমধ্যে মসজিদটি প্রায়শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখন এটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

বর্তমানে মসজিদটির একটিমাত্র গম্বুজ ও দেয়ালের কিছু কিছু অংশ কোন রকমে টিকে আছে। এগুলোর অবস্থাও খুব জীর্ণ। আদিতে এই মসজিদের আয়তন ছিল ৬২ গুণিত ৪২ ফুট। গম্বুজটির নিচের ইমারত বর্গের আকারে তৈরী এই বর্গের প্রত্যেক বাহু ২৮ ফুট লম্বা। এটি মাঝের গম্বুজ। বড় কামরার সামনের দিকে (পূর্ব) একটি বারান্দা ছিল। ইটের তৈরী এ মসজিদের বাইরে সুন্দর কারুকাজ করা ছিল। যার নমুনা খুব সামান্য থাকলেও রয়েছে।

খঞ্জন দীঘির মসজিদ কখন নির্মিত হয়েছিল এবং কে নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে মসজিদ তৈরীর নমুনা দেখে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে এটি পনের শতকে নির্মিত হয়েছিল।

ধনাইচকের মসজিদ:
খঞ্জন ধীঘি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের একটু দূরেই রয়েছে আর একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এই মসজিদের নাম ধনাইচকের মসজিদ। মসজিদটির পশ্চিম ও উত্তর দেয়ালের কিছু কিছু অংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর রয়েছে কয়েক স-ম্ভের কিছু কিছু অংশ, এগুলো পাথরের তৈরী।

অনেককাল আগের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে, মসজিদটিতে ৩টি গম্বুজ ছিল। মেহরাবে ছিল অতি সুন্দর লতাপাতা ও ফুলের কাজ। এ মসজিদটিও ১৫ শতকের নির্মাণ বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। তবে এর নির্মাতা কে এ সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায়নি।

মহারাজপুরের প্রাচীন মসজিদ:
মহারাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কারুকার্য খচিত একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। মসজিদটি কে নির্মাণ করেন সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। নির্মাণের সময় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও এটি যে মুঘল আমলের স'াপত্যকলা সে সম্পর্কে পণ্ডিতেরা একমত হয়েছেন। মসজিদের প্রধান গম্বুজটির ওপর ও নিচে সুন্দর লতা-পাতা খোদিত কারুকার্য রয়েছে। মসজিদের সামনের চত্বরে বেশ কিছু প্রাচীন বাঁধানো কবরও রয়েছে। কবরগুলো কার সে সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।

চাঁপাই জামে মসজিদ:
নবাবগঞ্জ সরদ থানার চাঁপাই গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এচি ৮৯৩ হিজরীতে নির্মিত হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আলী ওয়াজ খিজির নামক এক ব্যক্তি এই মসজিদের নির্মাতা বলে মসজিদ গাত্রে প্রাপ্ত লিপি থেকে জানা যায়।

মাঝপাড়া মসজিদ:
চাপাইনবাবগঞ্জ সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মাঝপাড়ায় একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এটি ‘মাঝপাড়া বালিগ্রাম জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। ৬টি গম্বুজ বিশিষ্ট এ প্রাচীন মসজিদটি আনুমানিক ১৭৭৫ খৃস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে নির্মাণের সঠিক সময় নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।

জনশ্রুতির মাধ্যমে জানা যায়, অযোধ্যার রোহিলা খণ্ড থেকে মনসুর আলী খান আনুমানিক ১৭০০ খৃস্টাব্দে নবাবগঞ্জ আগমন করেন। তাঁর পুত্র আমির আলী খান এ মসজিদ নির্মাণের সূচনা করেন। এলাহাবাদ থেকে আগত শেখ পরিবারের হাজী গোলাম হোসেন শেখের নামও মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত আছে।

জানা গেছে কাঁঠাল বাগিচাস' মরহুম আবুল ফজল খানের পূর্ব পুরুষ ছিলেন এই মনসুর আলী খান।

মসজিদটি সংস্কারের অভাবে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কোতোয়ালী দরওয়াজা:
জেলার শিবগঞ্জ থানার পশ্চিম সীমান- বালিয়া দীঘির প্রায় সন্নিকটে বাংলাদেশ চেকপোস্টের উত্তর সীমানায় অবসি'ত কোতোয়ালী দরওয়াজা প্রথম মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ভারতের মালদহ জেলায় প্রবেশ করতে বাংলাদেশীদের এই তোরণ অতিক্রম করতে হয়। প্রাচীন গৌড়ের রাজধানী নগরের দক্ষিণ প্রাচীরে এটি সদর তোরণ ছিল। অতীতে গৌড়ের রাজধানী নগরে প্রবেশ করতে হলে দক্ষিণ ‘নগর উপকণ্ঠে’র অধিবাসীবৃন্দকে এই তোরণ অতিক্রম করতে হতো। নগর দ্বার রক্ষার জন্য এখানে কোতোয়ালী স্থাপিত ছিল। সেই থেকে আজো এ প্রাচীন তোরণটি ‘কোতোয়ালী দরওয়াজা’ নামে প্রসিদ্ধ। নগর-দূর্গের অধিবাসীবৃন্দের দক্ষিমুখী পথও ছিল এটিই। এর উপরের খিলান বহুদিন আগেই পড়ে গেছে। এই তোরণটির উচ্চতা ৩১ ফুট বিস্তার ১৬ ফুট। প্রবেশ পথের দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। জেনারেল ক্যানিংহাম লিখেছেন “ইহা প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন।” সুলতান আলা-উদ-দীন খলজীর সমসাময়িক স্থাপত্য নিদর্শন বলে তিনি অনুমান করেছেন। তিনি আরো অনুমান করেছেন যে, সুলতান আলা-উদ-দীন খলজীর মৃত্যুর পর লখনৌতিতে দিল্লীর আধিপত্য বর্তিলে সেই সময় এই সুদৃশ্য নগর বেষ্টনী প্রাচীরের এই তোরণটি নির্মিত হয়।” এ মত মেনে নিলে (হিজরী ৬২৭) ১২২৯ খৃস্টাদ্বের কিছু পরে এটি নিমিত হয়েছিল বলতে হয়। ডাঃ দানী বলেছেন, “বঙ্গের সুলতান নাসির উদ্দীন মুহম্মদ শাহের ১ম আমলে (পাণ্ডুয়া হইতে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরিত হইবার পর) রাজধানী নগর দ্বার হিসাবে ইহা নির্মিত।” এই তোরণের উভয় পার্শ্বে ৬ ফুট বিশিষ্ট বৃত্তাকার দুইটি সান্ত্রীঘর ছিল, যা নানা প্রকার লতাপাতার কারুকার্যে বেশ যাঁকযমক ছিল। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সান্ত্রীরা পাহারারত থাকতো।

নওদা বুরুজ:
বখতিয়ার খলজী কর্তৃক আক্রান- হলে লক্ষণ সেন নদীয়ায় পালিয়েছিলেন ইতিহাস একথা বলে কিন্তু লক্ষণ সেনের আবাসস্থল এই নদীয়ার ঠিক কোথায় অবস্থিত ছিল ইতিহাস এ সমসার সঠিক মীমাংসা দিতে পারেনি। এ নিয়ে আজো চলছে নানা তর্ক বিতর্ক। রহনপুরের ‘নওদা বুরুজ’ এই বিতর্ককে বাড়িয়ে তুলেছে।

চাঁপাই নবাবগঞ্জের ২৮ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র রহনপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ক্ষুদ্র অথব খরস্রোতা নদী পুনর্ভবা। মহানন্দা ও পুনর্ভবার মিলনস'ল নিকটেই।

রহনপুরে রেল স্টেশনের ঠিক উত্তরে এক কিলোমিটার গেলেই বেশ কিছু উঁচু একটি ঢিবি নজরে পড়ে। দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় সহজেই।

নওদা বুরুজের চতুষ্পার্শ্বেই শুধু নয়- গোটা রহনপুর এলাকাতেই প্রাচীনত্ব ও নগর সুলভ চিন্‌হ বিরাজমান। কোন কোন ইতিহাস অনুসন্ধানী রহনপুরে প্রাক মুসলিম যুগের উন্নত নগরীর অবস্থানের উল্লেখ করেছেন।

কানসাটের জমিদার বাড়ী:
শিবগঞ্জ থানার কানসাট একটি প্রাচীন গ্রাম। এখানকার জমিদারদের আদি পুরুষ প্রথমত বগুড়া জেলায় বসতি স্থাপন করেন। দস্যু সর্দার পণ্ডিতা ডাকাতেক অত্যাচারে তাঁরা ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছাতে স্থানান্তরিত হন। পরে তাঁরা চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে এসে স্থায়ী হন। সূর্যকান্ত, শশীকান্ত ও শীতাংশুকান্ত এই বংশের অধস্তন বংশক্রম। প্রজা সাধারণের জন্য এঁরা কিছু রেখে যেতে পারেননি। এঁরা মুসলিম বিদ্বেষী জমিদার হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেন। বলাবাহুল্য জমিদারী কার্য ছাড়াও এঁরা হাতীর বেচা-কেনা’ করতেন। আসামে এঁদের ‘খেদা’ ছিল।

শিবমন্দির:
শহরের হুজরাপুরে একটি প্রাচীন শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরটি এক সময় প্রধান উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন এর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। দেয়ালের অনেক ইট খসে পড়েছে। পেছনের দেয়াল ভেঙ্গে বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখন আর এ মন্দিরে পুজা হয় না।

জোডা মঠ:
চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের হুজরাপুরে দু'টো মঠ বা মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অত্র অঞ্চলে পাশাপাশি মঠ আর কোন স্থানে দেখা যায় না। তাই এলাকাবাসীর কাছে এটি জোড়ামঠ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ার ফলে মঠ দু’টির চারিদিকে ও দেয়ালে নানান গাছ জন্মেছিল। কিছুদিন আগে তা পরিষ্কার করা হয়েছে। মঠ দু’টি মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। এককালে এই মঠ খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পুজা উৎসব পালিত হতো এক নজর দেখলেই তা বোঝা যায়। এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ মঠ নির্মাণের সময় এবং নির্মাতার নাম জানা যায়নি। এই মঠ দুটোর উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট হবে। জোড়া মঠের আশেপাশে এখনও প্রচুর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস লক্ষ্য করা যায়।

বারোঘরিয়ার কাছারী বাড়ী:
সদর থানার মহানন্দা নদীর তীরবর্তী বারোঘরিয়া বাজার থেকে ১৫০ গজ উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে একটি প্রাচীন বাড়ী। এটি একটি বাছারী বাড়ী। জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু মধুসূদন চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত বাবু যদুনন্দন চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন মালদহ জেলার অন্যতম ধনশালী ব্যক্তি। মহানন্দা নদীর তীর থেকে সমগ্র বারোঘরিয়া মহারাজপুর লক্ষীপুর, গুড়ীপাড়া (বর্তমানে নতুন বাজার) ঘোড়াপাখিয়া থেকে রাণীহাটি পর্যন- সমগ্র এলাকা ছিল তাঁদের জমিদারী আওতাভুক্ত। তাঁদের এই কাছারী বাড়ীতে থাকতেন নায়েব। তিনি প্রজাতের খাজনা আদায় করতেন। বাড়ীর বিশাল দরওয়াজার দু’ধারে শাস্ত্রীদের থাকার দু’টি ঘর আছে। ভেতরে দোতলা প্রাসাদের ৪টি কক্ষ রয়েছে।

দেশ বিভাগের পূর্ব থেকে এই কাছারীবাড়ীর নায়েব ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু হরিশ চন্দ্র ঝা। তিনি এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তিনি পুত্র শ্রীযুক্ত বাবু প্রতুল চন্দ্র ঝা ও কন্যা ভারতী রাণীকে নিয়ে ভারতে নিয়ে ভারতে চলে যান।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন- এই কাছারী বাড়ীর নায়েব ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু উমেশ চন্দ্র সরকার। ১৯৪৯ সালে উমেশ চন্দ্র সরকারের মৃত্যুর পর শ্রীযুক্ত বাবু নরেশ চন্দ্র ঠাকুর এ কাছারী বাড়ীর নায়েব হন। নায়েব থাকাকালীন সময়ে গোপনে তিনি জমিদারের অনেক জমি-জমা ও সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বিক্রি করেন। ১৯৫৪ সালের দিকে তিনি সপরিবারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে যান।

১৯৫৫ সালে এই কাছারী বাড়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে যায়। স্বাধীনতার পর সরকার এই বাড়ীতে একটি এতিমখানা চালু করেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত এই এতিমখানাটি সমপ্রতি চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রাচীন বাড়ীটি মেরামতের দিকে কারো দৃষ্টি নেই।
বালুয়া দীঘি

সেন বংশীয় রাজা বল্লাল সেন (রাজত্বকাল ১১৫৮-১১৫৯ খৃস্টাব্দ) শিবগঞ্জ-এর ফিরোজপুর এলাকায় একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। কালক্রমে তা ‘বালিয়া দীঘি’ নামে পরিচিত। বালুকাময় জলাশয় বলে এর নাম বালুয়া দীঘি হয় বলে অনেকে মনে করেন।

Leave your comments

0
terms and condition.
  • No comments found