x 
Empty Product

চলুন ঘুরে আসি আমের রাজধানী চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে (ভিডিও)

User Rating:  / 1
PoorBest 

বাংলাদেশের সর্ব পশ্চিমের একটি জেলা চাঁপাই নবাবগঞ্জ। এই জেলাটা বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত শিবগঞ্জ থানাটা সম্পুর্ন একটি আমবাগান বললে ভুল

বাংলাদেশের সর্ব পশ্চিমের একটি জেলা চাঁপাই নবাবগঞ্জ। এই জেলাটা বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত শিবগঞ্জ থানাটা সম্পুর্ন একটি আমবাগান বললে ভুল

হবেনা। যেদিকে তাকাবেন শুধুই আমের গাছ। সারি সারি গাছ একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। এর মাঝেই বসতবাড়ী দোকানপাট কলকারখানা।



চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে বিস্তির্ণ আম বাগান। যতই হাঁটবেন সারাদিন হাঁটলেও বাগান শেষ হবেনা। আমের মৌসুমে সারাদেশ থেকে লোক এখানে আসে আম কেনার জন্য, নিজ চোখে আম বাগান দেখার জন্য বা গাছ থেকে আম পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসীর জন্য আম আল্লাহর একটি বিরাট নেয়ামত কারন আমি দেখেছি এই এলাকার সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় আমকে কেন্দ্র করে। অবশ্য আম ছাড়াও এই এলাকায় আরোও অনেক কিছু আছে কিন্তু আম আসলেই সব কিছু ম্লান হয়ে যায়। নিচে আম, আমবাগান এবং চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার বেশ কিছু তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

আম কি?

আম এর পরিচয় পর্বে আমি উইকিপিডিয়া থেকে সরাসরি কপি পেষ্ট করলাম ।

আম (ইংরেজি: Mango) : ভারতীয় উপমহাদেশীয় এক প্রকারের সুস্বাদু ফল। কাচা অবস্থায় এর রং সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ রং হয়ে থাকে। বাংলাদেশ এবং ভারত এ যে প্রজাতির(species) আম চাষ হয় তার বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica. এটি Anacardiaceae পরিবার এর সদস্য। তবে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির আম আছে। আমের বিভিন্ন জাত (varity) আছে, যেমন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, অরুনা, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্নরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কালীভোগ, কাচামিঠা, আলফানসো, বারোমাসি, তোতাপূরী, কারাবাউ, কেঊই সাউই, গোপাল খাস, কেন্ট, সূর্যপূরী, পাহুতান, ত্রিফলা ইত্যাদী।


বিবরণ : আম গাছ সাধারণত ৩৫-৪০মি: (১১৫-১৩০ ফিট) লম্বা এবং সর্বোচ্চ ১০মি: (৩৩ ফিট) ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে। আম গাছ গুলো বহু বছর বাঁচে, এর কিছু প্রজাতিকে ৩০০ বছর বয়সেও ফলবতী হতে দেখা যায়। এর প্রধান শিকড় মাটির নিচে প্রায় ৬মি: (২০ ফিট) গভীর পর্যন্ত যেয়ে থাকে। আম গাছের পাতা চিরসবুজ, সরল, পর্যায়ক্রমিক, ১৫-৩৫ সে:মি: লম্বা এবং ৬-১৬ সে:মি: চওড়া হয়ে থাকে; কচি পাতা দেখতে লালচে-গোলাপী রং এর হয়। আমের মুকুল বের হয় ডালের ডগা থেকে, ফুল থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত প্রায় ৩-৬ মাস সময় লাগে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


চাষাবাদ ও ব্যবহার : ভারতীয় উপমহাদেশে আম কয়েক হাজার বছর ধরে চাষাবাদ চলছে, পূর্ব এশিয়াতে আমের প্রচলন হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতাব্দী থেকে এবং চাষাবাদ শুরু হয় আরো পরে খৃষ্টাব্দ ১০ম শতাব্দী দিকে। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের পর পৃথিবীর অন্য যেসব দেশে ভারতীয় উপমহাদেশের মত জলবায়ু রয়েছে, যেমন: ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা মেক্সিকো তে আরো অনেক পরে আমের প্রচলন ও উৎপাদন শুরু হয়। মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪ শতকে আমের বর্ণনা লিপি বদ্ধ করেন। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উষ্ণ প্রধান জলবায়ুর অঞ্চল গুলিতে আমের চাষাবাদ হয়। এর মধ্য অর্ধেকের কাছাকাছি আম উৎপাদন হয় শুধুমাত্র ভারতেই। এর পর অন্যান্য যেসব দেশ আম উৎপাদন করে তার মধ্যে আছে চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা, ইত্যাদি।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের আম :

 

 

 


বাংলাদেশে যতগুলো আম উৎপাদিত হয় তার সিংহভাগই চাঁপাই নবাবগঞ্জের। এ অঞ্চলের মাটির গঠন এবং আবহাওয়া আম চাষের জন্য সবোর্ৎকৃষ্ট। আমার ছোটবেলায় আমি যে সব এলাকায় ধান, গম ইত্যাদি ফসল চাষ হতে দেখেছি এখন তার কিছুই নেই । চতুর্দিকে শুধুই আম বাগান। যতদিন আম আছে এই এলাকার সবচেয়ে গরীব মানুষটিও হাতে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে ঘুরে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক ছয় বছরের একটি শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের একজন বৃদ্ধ সবাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আমের সংগে।

 

 

 


আমের মুকুল চাঁপাই নবাবগঞ্জের একটি শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক দৃশ্য। আপনি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবেন, চোখের পলক পড়বেনা। মৌ মৌ সুগন্ধে আপনাকে মাতাল করে দেবে। আম বাগান দিয়ে যখন হাঁটবেন তখন দেখবেন আপনার পা মাটিতে পড়ছেনা। আমের ঝরা মুকুল পড়ে মাটির উপরে হলুদ কমলা আস্তরন পড়ে আছে যেন সেখানে ছড়িয়ে দেয়া আছে অপরুপ এক গালিচা। দিন গড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে আমের মুকুল ঝরে যায় এবং সেখানে দেখা দেয় ছোট ছোট গুটি।

 
আমি যখন এই টিউনটি লিখছি তখন আম তার কৈশর বয়স অতিক্রম করছে। এখন পশ্চিমাকাশে এক টুকরা কালো মেঘ দেখা দিলেই সব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ব্যাগ বা বস্তা যার যেটা আছে সেটা নিয়েই ছুটবে আম গাছের নিচে। আবার সকাল হলেই আপনি বাড়ীর পাশ দিয়ে ধুপধাপ শব্দ শুনতে পাবেন। কে কার আগে বাগানে যেতে পারে। মায়েরা তার বাচ্চার কুড়ানো আম ছোট ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষন করেন সেটাকে বলা হয় "আমচুর"।


ছোট পুঁটিমাছ ছোল করে তার মাঝে কয়েক টুকরা আমচুর ছড়িয়ে দিলে তার স্বাদ আপনার মুখে লেগে থাকবে অনেকদিন। সেই আম কুড়িয়ে নিয়ে এসে কেউ বাজারে বিক্রি করে। এক টাকা, দুই টাকা কেজি এইভাবে আম বড় হবার সাথে দামও বৃদ্ধি পায়। একজন ছোট বাচ্চার কাছে সে যদি ঝড়ে পনেরো-বিশ কেজি আম কুড়ায় এবং সেগুলো বিক্রি করে ৩০-৪০টাকা পায় তবে আমাদের মতো অজপাড়া গ্রামে সেটাই লাখ টাকার শামিল। কারন এটা তার নিজস্ব ক্যাশ। কেউ এটাতে ভাগ বসাবেনা বা হিসাব চাইবেনা সে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করে। আপনারা নিজেদের ছোটবেলায় একবার ফিরে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করুন (সবাই না) দোকানে একটি খেলার জিনিস বা কোন কিছু খাওয়ার শখ হয়েছে কিন্তু বাবার কাছে চাইতে পারছেন না। বা চাইলেও অনেক সাধনা করতে হতো। কিন্তু আমাদের এলাকার বাচ্চাগুলোকে দেখলে আপনার এক ধরনের হিংসা হবে। তারা আমের সময় প্রত্যেকেই কমপক্ষে একশত টাকার মালিক। রাস্তা দিয়ে যখন তারা হাঁটে তখনও একটা মুডের মধ্যে থাকে। মার্বেল বলেন, লাটিম বলেন যদি ইচ্ছা হয় "হার্ডক্যাশ" দিয়ে সুতা এনে ঘুড়ি বানিয়ে অথবা কয়েকজনে চাঁদা তুলে ব্যাটবল কিনে রাজ্যসুখ ভোগ করে।




আম যখন একটু বড় হয় তখন ভিতরের আঁটি শক্ত হতে থাকে। এই সময় ঝড় হলে শুধু ছোট বাচ্চারাই নয় বড়রাও ছোটে আম বাগানের উদ্দেশ্যে। একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে আম কুড়ানোর প্রতিযোগীতা। আমের দামটাও তখন একটু বেশি থাকে। কেজিপ্রতি ৫টাকা বা তার উপরে দাম থাকে আমের। একজন মানুষ যদি ঝড়ের সময় আম বাগানে যায় এবং সে যদি সব চেয়ে অকর্মাও হয় তবেও কমপক্ষে বিশ-ত্রিশ কেজি আম কুড়াতে পারবে। এভাবেই মানুষ আমের সময় ফ্রি ফ্রি কিছু টাকা কামাই করে। ঝড় হলে ছেলে বুড়া ধনী গরীব বলে কোন কথা নাই। সবাই ছোটে আম বাগানের দিকে কারন আম কুড়িয়ে খাবার যে মজা, আপনাকে সারা পৃথিবীর সব আম গাছের মালিক বানিয়ে দেয়া হলেও আপনি সেটা পাবেন না। একজন বড় মাপের ধনীও যদি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকেন এবং গাছ থেকে আম পড়ে তবে তিনিও নিজেকে সামলাতে পারেন না।


এই সময় আম বিক্রি ছাড়াও সেটাকে রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে মাছের সঙ্গে আম রান্না করলে সেটা অমৃতের কাছাকাছি চলে আসে। মায়েরা শিশুদের কুড়িয়ে আনা আমগুলোকে আচার করার জন্য চার টুকরা করে সেটাকে লবন, মরিচ, হলুদ মাখিয়ে রোদে শুকাতে দেন। সেই জিনিস দেখলে আপনার জিহ্বায় পানি আসা ওয়াজিব। আমি লিখতে গিয়েও আমার জিহ্বায় জল অনুভব করছি। টক, ঝালের অপুর্ব সমন্বয়ে আপনাকে পাগল করে দেবে। আপনি যতই খাবেন মন ভরবে না। সবশেষে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আপনার হাজার বছরের তৃষ্ণা নিবারন করে দেবে। আমার মনে আছে আমি ছোটবেলায় আম কুড়ানোতে বেশ পারদর্শী ছিলাম। আমার আম্মু আমার আমগুলো আমার ইচ্ছামতো গুড় মিশিয়ে রান্না করতেন। আমি এবং আমার বোন ভাতের সঙ্গে, রুটির সঙ্গে আবার সারাদিন আঙ্গুলে লাগিয়ে রেখে খেতেই থাকতাম। আচারের জন্য আম শুকানোর সময়তো আমরাও বসে যেতাম রোদের মধ্যে । ভাইবোনে প্রতিযোগীতা করে খেতাম লবন মরিচ মাখানো কাঁচা আম। যেটুকু থাকতো সেগুলোকে সরিষার তেল মাখিয়ে বয়ামে করে রেখে দিতেন সারা বছরের জন্য। এখনও যদি কোন কারনে বাড়ীতে ভালো তরকারী না থাকে তবে কয়েকটুকরো আমের আচার দিয়েই আমরা পেটপুরে গরম ভাত খেতে পারি। আচার শব্দটার সাথে এখন আপনারাও বেশ পরিচিত। প্রতি বছর ঢাকায় আচার প্রতিযোগীতা হয়। বাজারেও নানা কিসিমের আচার কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু মায়ের হাতের তৈরি আচারের স্বাদ আপনি সারা পৃথিবীর বিনিময়েও পাবেন না।



আম পাকার সময় বাগান মালিকদের উদার মনোভাবের কিছুটা পরিবর্তন আসে। এই সময় আপনি আর স্বাধীনভাবে বাগানে ঘোরাঘুরি করতে পারবেন না। আমি টিউনের শুরুতেই বলেছিলাম ষাট বছরের বৃদ্ধদেরও আমের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক আক্ষরিক অর্থে শুরু হয় এখন। এলাকার সব গরীব বৃদ্ধ লোক এই সময় আম বাগান পাহারা দেয়। বাগানে একটা ছোট মাচা তৈরি করে সেখানে তার ছোট ছেলে বা নাতিদের নিয়ে রাত কাটায়। বাগান মালিকরা তাদের যে পারিশ্রমিক দেয় সেটা খুব মন্দ নয়। তারপরেও সারারাত যে পাকা আমগুলো পড়ে সেগুলো সকালে বাজারে বিক্রি করে এরা এক্সট্রা কিছু রোজগার করে।



আমার জানামতে সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ ছাড়া সব কিছুরই প্রকারভেদ আছে। আমেরও অনেক প্রকারভেদ আছে। আম নিয়ে যারা গবেষনা করেন তারা বিভিন্ন প্রকার আবিষ্কার করেন, বিভিন্ন দাঁতভাঙ্গা বৈজ্ঞানিক নাম দেন। কিন্তু আমরা যারা সাধারন পাবলিক তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাইনা। আমাদের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজার প্রজাতির আম গাছ। যার যেটা ইচ্ছা হয় আমের নাম দিয়ে দেন। আমার দাদার একটি ছোট বাগান আছে সেখানে বিশটা গাছ আছে যার প্রত্যেকটার স্বাদ ভিন্ন ধরনের। আমরা এগুলোর ইচ্ছামতো নামকরন করেছি। এর মধ্যে কিছু আম আগেই পেকে যায় আবার একজাতের আম যখন অলরেডি পেকে গেছে তখন দেখবেন অন্য কোন জাতের আম হয়তো পুরোপুরি আঁটি শক্ত হয়নি। সাধারনত ফজলি এবং আশ্বিনা এই দুই জাতের আম সবার শেষে পাকে। আশ্বিনা আমের নামকরন সম্ভবত বাংলা আশ্বিন মাসের নাম থেকে এসেছে। কারন সব প্রজাতির আম শেষ হবার পরেও এই আম প্রায় দুই মাস গাছে ঝুলতে থাকে।
এই লিংকে বেশ কিছু আমের ছবিসহ নাম জানতে পারবেন


বর্তমানে সারা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিও ছুয়েছে আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জে আম। গাছ থেকে আম পাড়ার পর সেগুলো ভ্যান বা নৌকায় করে প্রথমে আড়তে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ট্রাকে করে ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।



আমের ব্যবসা যেভাবে হয় :

এই পয়েন্ট টা লিখবো কিনা তা নিয়ে বেশ কনফিউশানে ছিলাম তার পরেও আপনাদেরকে আমাদের আম ব্যবসা সম্পর্কে কিছুটা ধারন দেয়ার জন্য লিখলাম। আমাদের এলাকার মানুষকে আমের দিক দিয়ে তিনভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমত : যাদের নিজের আম বাগান আছে। এই তালিকায় অধিকাংশ লোক পড়বে কারন আমাদের চাঁপাই নবাবগঞ্জ এলাকায় যেটুকু ফসলী জমি ছিল এখন তাও নেই প্রায় সবগুলোতেই আম বাগান হয়ে গেছে। অনেক পরিবার এখন বছরে বিভিন্ন ফসল উৎপন্ন করার ঝামেলায় না গিয়ে জমিটাকে আমবাগান বানিয়ে দিচ্ছে। ফলে সে কোনরুপ পরিশ্রম না করেই নগদ টাকা হাতে পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত : যাদের নিজস্ব কোন আম গাছ নেই বা থাকলেও সেটা পরিবারের চাহিদা পুরন করে। তবে আম বাগান সম্পর্কে ভালো ধারনা আছে। এরা নিজের কিছু টাকা থাকলে বা বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করে। লাভ যা হয় তার চার ভাগের এক ভাগ পায়। আর লস হলে কোন ক্ষতি নেই।

তৃতীয়ত : এরা সাধারন শ্রমিক বা দিনমজুর। সারা বছর নানা রকম টানাপড়নে অনেক কষ্টে এদের সংসার চলে। আমের সময় দেখা যায় আম মুকুল আসার কিছুদিন আগে থেকেই চলে বাগানে বিষ দেয়ার কাজ। তার পরে আম ভাঙ্গা (আম পাড়াকে আমরা আম ভাঙ্গা বলি), আম টুওয়া (শুধুমাত্র পাকা আম বেছে বেছে পাড়াকে আম টুওয়া বলে), নৌকা বা ভ্যানে করে আম আড়তে নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি কাজ এরা করে। সারা বছর কাজ না থাকলেও আমের সময় এদের সিরিয়াল পাবেন না। দিন আনা দিন খাওয়া বাদে শুধুমাত্র আমের সময়ই এরা নগদ কিছু টাকার মুখ দেখে।



উদাহরন : আমি আমার একটা বাগান নিয়ে আপনাদেরকে উদাহরন দিচ্ছি। আমি পড়াশোনা এবং ছোটখাট একটা দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আম বাগানে ঘোরার সময় এখন আর নাই। ব্যাবসা ভালো হওয়ার সুবাদে হাতে মাঝে মাঝেই কিছু নগদ টাকা জমে। তখন আমার এলাকার কিছু কিছু লোক আমাকে বাগান কেনার পরামর্শ দেয়। আমি বেশ কিছু আম বাগানের মালিক। তন্মধ্যে গত বছর জুলাই মাসে একজন আমাকে একটা বাগানের খোজ দেয়। সেখানে দুইটা ফজলী, একটা আশ্বিনা, একটা গোপালভোগ এবং একটা গুটি আমের গাছ আছে। আমবাগানের মালিক বাগানটি দুই বছরের জন্য বিক্রি করবে। দাম দর শুরু হলো। মালিকপক্ষ দাম চাইলো চল্লিশ হাজার টাকা । আমরা বললাম বিশ হাজার টাকা। সবশেষে ত্রিশহাজার পাঁচশত টাকায় বাগানটি আমরা কিনলাম। এই বেচাকেনাটা দেড়শ টাকার ষ্ট্যাম্পে লিখিত করে নেয়া হয়। আমরা তিনভাগে বাগানটা কিনলাম। অর্থাৎ আমার ভাগ তিনভাগের এক ভাগে খরচ পড়লো দশহাজার দুইশত টাকা প্রায়। মাঝে মাঝে বিষ দেয়া, সার দেয়া ইত্যাদি বাবদ এই এক বছরে আরোও প্রায় একহাজার টাকা আমার পকেট থেকে গেছে। এইবার আম ধরেছে ফজলী ২টাতে বিশ মণ, আশ্বিনাতে দশমণ, এবং গোপালভোগ ও গুটি মিলিয়ে আরোও পনেরো মণ হবে। বলে দেয়া ভালো আমাদের এলাকার প্রায় সব মানুষ গাছ দেখে প্রায় নিখুত ভাবে আপনাকে বলে দেবে এই গাছে কত মণ আম হবে। আপনি যদি দাম হিসাব করতে যান তবে আনুমানিক ষাটহাজার টাকার আম বাগানটাতে ঝুলছে। এখন যারা আম কেনা বেচার ব্যবসা করে তারা আমাদের কাছে ঘুরছে বাগানটা কেনার জন্য। এখন পর্যন্ত সর্বচ্চো পয়তাল্লিশ হাজার টাকা আমাদের দাম বলেছে। আমরা পঞ্চাশ হাজারের নিচে বাগানটা বিক্রি করবোনা নিয়্যাত করেছি। আমরা যদি পয়তাল্লিশ হাজারেও বাগানটা বিক্রি করি তবেও হাজার চারেক টাকা আমাদের লাভ থাকছে । আর যেহেতু দুই বছরের জন্য কিনেছি সেহেতু সামনের বছর যা পাবো সেটা ফাও।


এভাবেই চলে আমাদের এলাকার আমের ব্যবসা। আমি জাষ্ট একটা উদাহরন দিলাম আমার বাগান নিয়ে। এমনও দেখা যায় বাগান মালিক দশবছর পনেরো বছরের জন্য তার বাগান বিক্রি করে দিয়েছে। সেই বাগান হয়তো সাত-আটবার কেনাবেচা হয়েছে। সবাই কিছুনা কিছু লাভ করেছে। দেখা যায় বাগান মালিক বাগানের কোন খোজখবর রাখেন না। গাছের যা যত্ন-আত্তি করার দরকার তা ক্রেতাপক্ষ নিজ দায়িত্বে করে কারন যত্ন করলেই ফলন ভালো হবে।

আমাদের এলাকায় আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। কানসাট নামটা আপনাদের কাছে কিছুটা পরিচিত হবার কথা কারন কয়েক বছর আগে এখানেই পল্লী বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রায় বিশজন লোক পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দুরে কানসাট। সকাল হলেই দেখবেন সাইকেল বা ভ্যানে করে দুর দুরান্ত থেকে মানুষ ঝুড়িতে করে আম নিয়ে আসছে। এতবড় চওড়া রাস্তাতেও আপনাকে রীতিমতো জেহাদ করতে হবে চলাফেরার জন্য। বিকাল পর্যন্ত সরগম থাকে এই বাজার। কানসাট ছাড়াও রহনপুর, ভোলাহাট বা অনান্য জায়গায় আমের বাজার বসে। এসব এলাকা থেকে আম ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে।


যদি আসতে চান তবে............

আমরা আমাদের উৎপাদিত আম আপনাদের কাছে এমনিতেই পৌঁছে দিচ্ছি। তারপরেও আপনার যদি একান্ত ইচ্ছা হয় আমবাগান দেখার তবে আপনি চলে আসতে পারেন আমের রাজধানী চাঁপাই নবাবগঞ্জ। মে-জুন মাস এখানে আসার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময় চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা আমে ভরপুর থাক। ঢাকার কল্যানপুর ও গাবতলী থেকে বিভিন্ন বাস পরিবহন আসে চাঁপাই নবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে। যেমন হানিফ, মডার্ণ, ন্যশনাল ইত্যাদি। ভাড়া নিবে ৩০০-৩২০টাকা। আপনি নবাবগঞ্জ শহরেও নামতে পারেন আবার সরাসরি কানসাটেও চলে আসতে পারেন এসব পরিবহনে। থাকার জন্য মোটামুটি মানের কিছু হোটেল আছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরে। তন্মধ্যে হোটেল স্বপ্নপুরী (০৭৮১-৫৬২৫০), হোটেল আল নাহিদ (০১৭১৩-৩৭৬৯০২) ইত্যাদি অন্যতম। ভাড়া প্রতি রাত ২০০ থেকে ১০০০ হওয়ার কথা। (টেকটিউনস পরিবারের সদস্যগন আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সামনে পরীক্ষা তারপরেও সহযোগীতা করার চেষ্টা করবো)।


আম ছাড়াও আমাদের কিছু সম্পদ যা আপনাদের মন কেড়ে নিতে পারে :

ঐতিহাসিক গৌড় শহরের বেশ কিছু স্থাপনা এখনও আমাদের এলাকায় আছে। যদিও কিছু অংশ ভারতের দিকে পড়েছে তবু যা আমাদের আছে সেটা কোন অংশে কম নয়।
ছোট সোনামসজিদ :

চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার দুরে মেইন রোডের ধারে অবস্থিত কালো পাথরে নির্মিত এই মসজিদটির নির্মানশৈলী আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। এর নির্মানের সময় জানা যায়নি তবে ধারনা করা হয় সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) এর আমলে নির্মিত। মসজিদটির মুল ভবন আয়তাকার। উত্তর ও দক্ষিন দিকে তিনটি করে এবং পুর্ব দিকে পাঁচটি দরজা আছে। মসজিদটির সম্মুখভাগে দুইটি সমাধি আছে।



ঐতিহাসিক কানিংহ্যামের মতে এগুলো মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মাদ এবং তার পিতা আলীর সমাধি।
বীরশ্রেষ্ঠ মুহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি :

ছোট সোনামসজিদের সামনেই অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ মুহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর সমাধি। এখানে দাঁড়িয়ে আপনি ফিরে যেতে পারবেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। এই বীর চাঁপাই নবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জের মাটি তার রক্তে উর্বর হয়ে আছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসী বেশ গর্ব করেই এই মহান বীরের নাম স্মরন করে।
তোহাখানা :

সোনা মসজিদের পশ্চিমে মেইন রোড থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পাবেন বিশাল একটি দীঘি। সেই দীঘির পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। সোনামসজিদের মতো এটারও নির্মানকাল জানা যায়নি । ধারনা করা হয় মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা তার বসবাসের জন্য এটা তৈরি করেছিলেন।
শাহ নিয়ামতুল্লাহ এর মাজার :

বাংলাদেশে যে কয়জন প্রসিদ্ধ দরবেশ ইসলাম প্রচার করতে আসেন হযরত শাহ নিয়ামতুল্লাহ (রহ তাদের একজন। তিনি এখানে ১৬৬৪সালে মারা যান। তোহাখানার উত্তর পাশেই তারা মাজার। তার মাজারের আশেপাশে বেশ কিছু প্রাচীন কবর রয়েছে। মাজারের দক্ষিন পাশে অর্থাৎ তোহাখানা এবং মাজারের মধ্যখানে তিনগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে।


দরসবাড়ী মসজিদ :

এটি একটি ধ্বংশপ্রাপ্ত মসজিদ তবুও আপনি এখানে না গেলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ আসা পুর্ণতা পাবেনা। বিশাল বিশাল দালানগুলো শতশত বছর ধরে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গম্বুজগুলো ধ্বংশ হয়ে গেলেও দালানগুলো এখন সরকারের নজরে আসার কারনে বেশ সুন্দর লাগবে। ইটের মধ্যে নানা রকম কারুকাজ দেখতে দেখতে কখন সময় গড়িয়ে যাবে টের পাবেন না।


যাদের সাহস আছে তারা বেশ কষ্ট করে দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারেন উপরে। প্রায় তিনফিট ওয়ালের উপর উঠলে আপনি পাবেন রাজ্য জয় করার আনন্দ। তবে নতুন গিয়ে উপরে উঠা ঠিক হবেনা। আর পাহারাদার থাকলে আপনি উপরে ওঠার সুযোগও পাবেন না।
দরসবাড়ী মাদ্রাসা :

শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৬সালে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এই মাদ্রাসাটি নির্মান করেছিলেন। কয়েকজন কৃষক জমি চাষ করার সময় ইটের ঢিবি আবিষ্কার করলে ১৯৭৪ সালের দিকে সেখানে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর খনন কার্য চালায় এবং মাদ্রাসাটির সন্ধান পায়। ৫৫মিটার বর্গাকৃতির এই স্থাপনায় ৩মিটার বর্গাকৃতির চল্লিশটি ঘর ছিল। এখন যদিও ঘরগুলোর নিচের অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবুও দরসবাড়ী মসজিদ এবং মাদরাসা আপনাকে নিয়ে যাবে ৫০০বছর আগে।
খনিয়াদীঘি মসজিদ :

সোনা মসজিদ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরে আমবাগানের ভিতর অবস্থিত এই মসজিদ। মসজিদটির মুল অংশের ঠিক উপরে একটি বিশাল গম্বুজ আপনাকে আকর্ষন করবে। এর দেয়ালে নানা রকম কারুকাজ আপনি ভুলতে পারবেন না অনেকদিন।
মহানন্দা নদী :

সবগুলো যখন হলো তখন মহানন্দা নদী আর বাদ যায় কেন। বাংলাদেশে বর্তমানে অনান্য নদীগুলোর মতো মহানন্দার অবস্থাও ভালো নয়। তবে আমাদের এলাকায় পানি দুষন না থাকায় আপনি এখন আসলে পাবেন কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানি। (শহরের অংশটুকু বাদে) অধিকাংশ স্থানে এখন পানি নেই বা থাকলেও সেটা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হাঁটুজল। নদীটি ভারত থেকে ভোলাহাট থানায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে নবাবগঞ্জ জেলাকে অতিক্রম করে পদ্মার সাথে মিশেছে। এই নদীর উপর দুইটা সেতু আছে। একটা নবাবগঞ্জ শহর থেকে সোনামসজিদ যাবার পথে এবং অপরটি চৌডালা-গোমাস্তাপুর এলাকায়।
কোতওয়ালী দরজা :

এটা আপনি দুর থেকে দেখতে পাবেন। কারন এই দরজাটি ভারতের অংশে পড়েছে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের শেষ মাথায় সীমান্ত থেকে আপনি এটা দেখতে পাবেন।

ও হাঁ বলতে ভুলে গেছি কানসাট বাজারের মধ্যে অবস্থিত রাজবাড়ীর কথা বলতে। কানসাট বাজারের মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল ফুটবল মাঠ এবং তার উত্তরেই রয়েছে দোতলা প্রাচীন একটি রাজবাড়ী। আপনি যদি কানসাটে কিছুটা সময় কাটান তবে দুই মিনিট এখান থেকে ঘুরে আসুন।

6QRAhKRCko4">6QRAhKRCko4" type="application/x-shockwave-flash" allowfullscreen="true" width="540" height="400">

Leave your comments

0
terms and condition.
  • No comments found