x 
Empty Product
Thursday, 22 April 2021 23:36

নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের উপকারিতা

Written by 
Rate this item
(0 votes)

লাল সালু পাকা আম, কুড়ে যদি পাইতাম ছাল ছোলে খাইতাম ইশ্‌ রসে গান গাইতাম! ফলের রাজা আম। কে বা না জানে? এ আম নিয়ে রয়েছে বহু ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস। আমের আদি নিবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে ১৫২ জাতের আম রয়েছে যার মধ্যে ৩১ টি জাত অধিকহারে চাষাবাদ হচ্ছে। আম উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দেশে আম উৎপাদন প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ফলের পুষ্টির চাহিদার বড় অংশের যোগান দেয় এ আম। ভিটামিন ’এ’ এর উৎস হিসাবে আমের স্থান পৃথিবীর সকল ফলের উপরে। আম হজম শক্তি বৃদ্ধিতে, শরীর ফিট রাখতে, দেহের শক্তি বাড়াতে এবং শরীরের ক্ষয়রোধ করতে সহায়তা করে। আমে উচ্চ পরিমান প্রোটিন এর উপসি’তি যা জীবানু থেকে দেহকে রক্ষা করে, পুরুষের যৌনশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং শুক্রাণুর গুনগত মান ভালো রাখে। লিভারের সমস্যায় কাঁচা আম বেশ উপকারী। আম শরীরের রক্তে কোলেস্টেলের মাত্রা কমায় এবং আমাদের হার্টকে সুস’ ও সবল রাখে। পর্যাপ্ত পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপস্থিতির কারণে শরীরের ক্যান্সার প্রতিরোধে আম বেশ সহায়ক। তাছাড়া পাকা এবং কাঁচা আমের জুস খেতে কার না ভালো লাগে? যে আমের এত উপকারিতা সে আম যদি নিরাপদ ও বিষমুক্ত হয় তাহলে আর কথায় নেই। নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কর্তৃক এ প্রযুক্তিটি উদ্ভাবিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চল সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উহা একটি লাভজনক প্রযুক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আম পোকা এবং চুকা।এই প্রবাদ বাক্যটি বহুদিনের পুরানো। কিন’ সেদিন আর নেই। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কারনে এবং নতুন নতুন আমের জাত উদ্ভাবনের সুবাধে মানুষ এখন অনায়সে মিষ্টি-মধুর আম ভক্ষণ করতে পারছে। কিন’ সমস্যা থেকে যাচ্ছে পোকার আক্রমণ। মাছি পোকা হলো আমের প্রধান শত্রু। তাছাড়া ক্রমাগত আবহাওয়ার বিরুপ প্রভাবের কারনে নতুন নতুন পোকার আক্রমণ ঘটছে। ফলে আম বাগানীরা তা দমনের জন্য অনায়াসে কীটনাশক প্রয়োগ করে যাছে। এ কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রা সীমাহীন। তাতে শ্রম এবং টাকা দু’টোই গচ্ছা যাচ্ছে। পরিবেশেরও বেশ ক্ষতি হচ্ছে। তাতেও আমকে কিছুটা পোকামুক্ত করতে পারলেও আমটি কিন’ আর নিরাপদ থাকছে না। অন্যদিকে ভোক্তারা চায় নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম। আমের ব্যাগিং প্রযুক্তিটি চীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও ইন্দোনেশিয়াসহ বহু উন্নয়নশীল দেশে ব্যাপক আকারে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত দশক থেকে এ প্রযুক্তিটি রাজশাহী, শিবগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ সহ উক্তরাঞ্চলে বেশ সাড়া ফেলেছে। সেখানে আম বাগানীরা কোটি কোটি আম ব্যাগিং করছে। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে ২০১৭ সাল থেকে পরীক্ষমূলকভাবে আমে ব্যাগিং শুরু হয়। বর্তমানে পাহাড়ী অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ প্রযুক্তিটি লাভজনক হিসাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রযুক্তিটি ব্যবহারের আগে হাতে-কলমে শিখে নেওয়া ভালো। বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪, মল্লিকা, আশ্বিণা ইত্যাদি আমে ব্যাগিং করলে ভালো লাভ পাওয়া যায়। একটি গাছের সব আমে ব্যাগিং করতে হবে এমন কোন কথা নেই। ঝুঁকিপূর্ণ বড় আম গাছে আম ব্যাগিং না করাই ভালো। সাত ফিট উঁচু মইয়ের উপর উঠে যতটুকু আম ব্যাগিং করা যায় ততটুকুই করা ভালো। বানিজ্যিকভাবে বড় গাছে আম ব্যাগিং এর জন্য বারি সম্প্রতি সেল্প প্রপেল্ড হাইড্রলিক লিফটার উদ্ভাবন করেছে।
আগাম জাতের আমের গুটির বয়স ৪০-৫৫ দিন এবং নাবী জাতের গুটির বয়স ৬০-৬৫ দিন হলে ব্যাগ পরানো যায়। সাধারনত: জাতভেদে মধ্য এপ্রিল থেকে এপ্রিল শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যাগিং এর উপযুক্ত সময়। ব্যাগিং করা আম সংগ্রহ করার পর ভালোভাবে পাকিয়ে খেলে এর মিষ্টতা তেমন কমে না। এক্ষেত্রে ব্যাগিং করার সময় ও পদ্ধতি সঠিকভাবে মেনে চলা উচিত।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি বলতে ফল গাছে থাকা অবস’ায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা বয়সে বিশেষ ধরণের কাগজের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায়। ব্যাগিং করার পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকে ব্যাগটি। আমের জন্য দুই ধরণের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। রঙিন আম বা আমের অরিজিনাল রঙ ঠিক রাখার জন্য সাদা ব্যাগ আর অন্যান্য জাতের জন্য বাদামি রং এর দু’স্তরের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বাদামী রঙের ব্যাগ ব্যবহার করলে আমের রঙ খুবই উজ্জল হলুদাভ আকর্ষণীয় হয়। ফলে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়। গবেষণায় দেখা গেছে সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি মেনে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে আমের রোগ এবং পোকা শতভাগ দমন করা যায়। ব্যাগিং এর কারণে আমের গায়ে কালো দাগ পড়ে না এবং বালাইনাশকের ব্যবহার ৭০-৮০ ভাগ কমে ফলে পরিবেশ ও জনস্বাসহ্য সুরক্ষা হয়। ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। যার সংরক্ষণকাল জাতভেদে ১০-১৪ দিন পর্যন্ত বাড়ে। আমকে বাইরের বিভিন্ন ধরনের আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। তাই ছাদ বাগানের আম গাছেও এটি ব্যবহার করা যায়। ব্যাগিং করা আমের গুনগত মান বজায় থাকে। তবে স্বাদ ঠিক রাখতে ব্যাগিং আম ভালভাবে পাকিয়ে খেতে হবে।
আমের ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহারে লাভের চাইতে খরচের পরিমান অতি নগণ্য। শুধুমাত্র ব্যাগ ক্রয়ের খরচ এবং ব্যাগ লাগানো ও খোলার জন্য শ্রমিক প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে জাতভেদে প্রতি টন আমে ব্যাগিং খরচ ৬২৭০ টাকা অর্থাৎ প্রতি কেজি আমের ব্যাগিং খরচ ৬.২৭ টাকা যেখানে ব্যাগের মূল্য ৪ টাকা হিসাব করা হয়েছে। ব্যাগিং আমে বাজার মূল্য অধিক পাওয়া যায়। জাতভেদে ব্যাগিং আমের গড় বিক্রি মুল্য প্রতি কেজি ৬০.৫৯ টাকা যা নন-ব্যাগিং আমে গড় ৩৪.৮১ টাকা। এক্ষেত্রে উভয়ের প্রতি কেজির পার্থক্য ২৫.৭৮ টাকা যা ব্যাগিং আমে ৭৪% বেশি মুল্য পাওয়া যায়। ব্যাগিং খরচ ভিত্তিতে প্রতি টন ব্যাগিং আমে নিট লাভ ৫৭৫৫০ টাকা যা নন-ব্যাগিং আমে ৩৪৭৬০ টাকা। প্রতি টন আমে উভয়ের নিট লাভে পার্থক্য ২২৭৯০ টাকা। এতে প্রতিয়মান হয় যে, আমের মূল্য সংযোজনে ব্যাগিং একটি লাভজনক প্রযুক্তি। ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহারের পূর্বে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী বা কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। গুগল প্লে ষ্টোর থেকে বারি’র কৃষি প্রযুক্তি ভান্ডার এপসটি ইনস্টল করে নেওয়া যেতে পারে। সেখানে অন্যান্য প্রযুক্তি সেকশনে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসাবে এটি লিপিবদ্ধ আছে।
প্রযুক্তিটি দ্রুত সম্প্রসারনের জন্য কৃষক এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে আসছে। ব্যাগিং প্রযুক্তির উপকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন মিডিয়া এবং সম্প্রসারন কর্মীদের সহায়তায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষি তথ্য সার্ভিস অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। মানসম্মত ব্যাগ তৈরির জন্য স’ানীয়ভাবে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরির উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। ব্যাগ প্রাপ্তি সহজ লভ্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ডিলারদের সাথে কৃষক বা কৃষক সংগঠনের সংযোগ বাড়াতে হবে। তবেই নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদন ও বাজারজাতকরন সম্ভব হবে। একই সাথে আম রপ্তানীরও সুযোগ বাড়বে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃষি অর্থনীতিবিদ, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।


এই নিউজটির মুল লিখা আমাদের না। আমচাষী ভাইদের সুবিধার্তে এটি কপি করে আমাদের এখানে পোস্ট করা হয়েছে। এই নিউজটির সকল ক্রেডিট: https://dainikazadi.net

Read 1629 times

Leave a comment

Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.