বউভুলানী, রানীপসন্দ, জামাইখুশি, ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, বৃন্দাবন ইত্যাদি বাহারি নামের সুস্বাদু আমে দেশের বাজার ভরে আছে বেশ কয়েক দিন ধরে। দেশের আমের এ বাজার প্রায় একচ্ছত্রভাবে দখলে রেখেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এর মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম শিবগঞ্জের কানসাট ও ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন।
এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ আমের বাজার শিবগঞ্জের কানসাট। এ বাজারে ছোট-বড় প্রায় ৩০০ আমের আড়ত রয়েছে। কানসাট আম আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী এমদাদুল হক জানান, কানসাটে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয়। আম আড়তদার জুয়েল, টিপু, নজরুল ইসলাম, হারুনসহ কয়েকজন আম আড়তদার জানান, এখান থেকে আমের একটি বড় অংশ প্যাকেটবন্দি হয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ফল ব্যবসায়ী এখানে আম কিনতে আসেন। আম বেপারি আবুল কালাম, সহিদুল ইসলাম ও আবদুস সাত্তার জানান, প্রতিদিন শুধু কানসাট থেকেই শতাধিক ট্রাক আম দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। আমের বড় বাজারের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলস্টেশন আম বাজার অন্যতম। এবারের আম মৌসুমে জেলায় অন্তত ২৪টি ছোট-বড় বাজার বসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার আমের ৫০ শতাংশই শিবগঞ্জে উৎপন্ন হওয়ায় কানসাট বাজারে প্রচুর আমের সরবরাহ থাকে। শিবগঞ্জে উৎপাদিত আম দেশে উৎপাদিত আমের প্রায় ৪০ শতাংশ। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ফল ব্যবসায়ীরা ভিড় জমাচ্ছেন কানসাটে। বর্তমানে শুধু কানসাট বাজার থেকেই প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০ ট্রাক আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। গুটি, গোপালভোগ ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি (হিমসাগর) প্রায় শেষের পথে। এখন বাজারে ও বাগানে রয়েছে ল্যাংড়া ও ফজলি। তুলনামূলক সুমিষ্ট হওয়ায় ল্যাংড়ার চাহিদাই বেশি। চাহিদার পাশাপাশি অন্যান্য জাতের তুলনায় ল্যাংড়া আমের দামও বেশি। আম ব্যবসায়ীদের দাবি, গতবারের চেয়ে এবার আমের উৎপাদন বেশি হলেও দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে তাঁরা ক্ষতির শিকার হতে পারেন।
আম আড়তদার আনোয়ারুল হক টিপু জানান, আমের দাম প্রতিনিয়ত ওঠানামা করছে। এমনকি এক ঘণ্টার ব্যবধানে আমের দর পরিবর্তনের নজিরও রয়েছে। বর্তমানে মানসম্মত হিমসাগর ও ল্যাংড়া তিন-সাড়ে তিন হাজার আর ফজলি এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা মণ (৪৫ কেজি) দরে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের শুরুতে দাম কম থাকলেও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় প্রতিটি জাতের আমের দামই কিছুটা বেড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় আড়াই শ জাতের আমের চাষ হয়। ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমগাছের পরিমাণ প্রায় ২২ লাখ। এর মধ্যে সুস্বাদু ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি ক্ষীরশা, বৃন্দাবনী, লক্ষ্মণভোগ, কালীভোগ জাতের আমের চাষই হচ্ছে বেশি। ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় শিবগঞ্জে গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান সম্প্রসারিত হয়েছে। শিবগঞ্জে সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ আমগাছ রয়েছে। এবার হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আম মৌসুমে এ অঞ্চলে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে।
এদিকে বাগান থেকে আম চুরি রোধ, আমচাষিদের প্রশিক্ষণ ও আমসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় এক যুগ আগে গড়ে ওঠে ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন। পরে আম বাজার করার জন্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগেই কেনা হয় ১৪ বিঘা জমি। প্রতিষ্ঠানটি আমচাষি, ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের স্বার্থসহ ন্যায্যমূল্যে আম কেনাবেচার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, আমবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তি, আমে ক্ষতিকারক কার্বাইড মেশানো প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে কাজ করছে। আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ তৈরিরও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফাউন্ডেশনটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম তোতা ও সহসভাপতি মাহতাব উদ্দিন জানান, ২০০১ সালে আম বাগান মালিক ও চাষিরা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন গড়ে তোলে। সীমান্তবর্তী রেশমসমৃদ্ধ ভোলাহাটে এই ফাউন্ডেশনের গড়ে তোলা আম বাজারের সুবিধা ভোগ করছেন এলাকার আম বাগান মালিক, ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই।
এলাকাবাসী জানায়, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, আর্থিক লেনদেনের জন্য বেসরকারি ব্যাংক স্থাপনের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং চালু করা, বাইরের বেপারিদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করাসহ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে এ এলাকার আমের বেচাকেনায় আরো অনেক সুবিধা হতো।
Published in
ব্লগ
Tagged under
Latest from Super Admin
Leave a comment
Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.