বাংলাদেশে উৎপাদিত ফলের মধ্যে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় সুস্বাদু ফল। এটি দেশের সর্বত্র জন্মে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, স্বাদ-গন্ধ ও পুষ্টিমানে ইহা একটি আদর্শ ফল এবং এ জন্য আমকে ‘ফলের রাজা’ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৭,৪৬৬ হেক্টর জমি থেকে ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস, ২০১২)। আমে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। তাছাড়া এই ফলে অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কাঁচা আম ফালি বা আমচুর, চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। পাকা আম থেকে জুস, আমসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি ইত্যাদি তৈরি হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ, ভেষজ চিকিৎসায়, আসবাবপত্র ও জ্বালানি হিসেবে আম কাঠের ব্যবহারসহ রয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব। বর্তমান সরকার আম গাছের পরিচিতি, ফলের জনপ্রিয়তা, জাতীয় সঙ্গীতে আমের স্থান এবং দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আম বাগানের নিবিড় সম্পর্ক থাকায় আম গাছকে ১৫/১১/২০১০ জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করেন।
আম রপ্তানির গুরুত্ব
এক দেশের পণ্য অন্য দেশে বিক্রি করা হলে তাকে রপ্তানি বলা হয়। আর যখন আম নামের পণ্য বিদেশের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয় তখন তাকে আম রপ্তানি বলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উপায় হলো বিদেশে আম রপ্তানি। আম রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি সঞ্চারিত হয়। তাই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আম রপ্তানির গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ছাড়াও আম রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
ক) দেশে আমের উৎপাদন বৃদ্ধি;
খ) আমের তালিকায় নতুন জাতের সংযোজন;
গ) বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের আমের পরিচিতি;
ঘ) অধিক কর্মসংস্থান;
ঙ) দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন;
চ) বিদেশের বাজারে লেনদেন ক্ষমতা ও সুনাম বৃদ্ধি এবং
ছ) দেশের ঐতিহ্যবাহী আম শিল্পকে উন্নত করা ইত্যাদি।
আম রপ্তানির সমস্যা
বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম (এফএও-২০১১) স্থানে থাকলেও আম রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে কোন অবস্থানে নেয় (সিআইএ ওয়ার্ল্ডবুক-২০১১)। কারণ রপ্তানিযোগ্য আমের কিছু শর্ত ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক যেমন- প্রতিটি আম রোগের জীবাণু, পোকামাকড়, হেভি মেটাল ও দাগ মুক্ত হওয়া। তাছাড়া আমের ওজন ২০০-৩৫০ গ্রাম, চামড়া রঙিন, শাঁস দৃঢ় ও অল্প মিষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দেশীয় আমে উপরোক্ত বিষয়গুলোর অনেকটা অভাব পরিলক্ষিত হয় বিধায় সেই আমগুলোকে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া আম রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সমস্যাগুলো নিম্নরূপ-
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ;
আমের প্রাপ্তিকাল খুবই সীমিত;
হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা না থাকা । ফলে আম উজ্জ্বল, বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত করা যায় না;
আম পাকানো ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার;
সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন- প্যাকেজিং ও পরিবহন সন্তোষজনক নয়;
কৃষক ও রপ্তানিকারকদের সম্পর্ক না থাকা এবং এ ব্যাপারে কোন তথ্য না জানা;
বিদেশি আমদানিকারকদের আমাদের দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত না থাকা;
গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম যথেষ্ট শত্তিশালী না হওয়া;
কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড না জানা;
ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট নিতে ঝামেলা/হয়রানি/দুর্নীতি;
এয়ার কার্গো কম এবং
সরকারি সহযোগিতা, নীতিমালা ও লোন পর্যাপ্ত নয়।
রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয়
বাংলাদেশে উৎপাদিত ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আমের বেশির ভাগই দেশের ক্রেতারা ক্রয় করে থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণে আম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর এবং আশ্বিনা জাতের আম রপ্তানি হয়ে থাকে। বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ বিদেশে রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় জাত। তাছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতী ও বারি আম-৩ WalMart এর চাহিদার তালিকায় রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আম আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদিআরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। তবে উল্লিখিত দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীরাই প্রধানত সব আমের প্রধান ক্রেতা। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে রপ্তানির উপযোগী আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
সার ও সেচ প্রয়োগ এবং রোগ বালাই দমনে আধুনিক কলাকৌশল অর্থাৎ সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক পদ্ধিতে সার, সেচ ও বালাইনাশক ব্যবহারের মধ্যেমে আমের অধিক ফলন নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণকে কৃষি গবেষণার সঙ্গে সমন্বয় করে আম চাষি-ব্যবসায়ীদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সঠিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশি বেশি বেশি করে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো অর্থাৎ জৈব প্রযুক্তি নির্ভর আম উৎপাদনে উৎসাহিত করা।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় আম চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া দরকার। তাছাড়া রাস্তার দুই ধারে এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আম গাছ লাগাতে হবে।
আগে থেকে জন্মানো গুটি আমের গাছগুলোকে না কেটে টপ-ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ভালো জাতে পরিবর্তন করে আমের উৎপাদন বাড়ানো।
সরকারি ও বিএডিসির উদ্যান নার্সারিগুলোকে আরও উন্নত মানের এবং ভালো জাতের চারা কলম সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আমের প্রাপ্তিকাল বাড়াতে হবে যাতে করে দীর্ঘ সময় ধরে আম পাওয়া যায়।
আম পাকানো ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ করা।
হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা থাকা। এতে আম উজ্জ্বল, বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত হবে।
আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া।
রপ্তানির সহিত সংশ্লিষ্ট আম উৎপাদনকারী, আম সরবরাহকারী এবং আম রপ্তানিকারকদের সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা, তাদের নিবন্ধন করা ও সমিতির আওতায় এসে স্বমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।
স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে জনগণ ও সরকারকে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। বিদেশে অনেক দেশে আম চাষি সমিতি আছে- এ সমিতিই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে যাতে করে কোন চাষি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
আম ব্যবসায়ীদের বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমের আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে হবে।
আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ তৈরি, হিমায়িত পরিবহন, দ্রুত স্থানান্তরকরণ, বাছাই, প্যাকেজিং এবং গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সমবায় ভিত্তিতে আম সংরক্ষণ স্থাপনার ব্যবস্থা করা।
অধিক গবেষণা করে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী জাত উদ্ভাবন করা।
বিদেশ থেকে আম আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে।
আম রপ্তানির সম্ভাবনা
এদেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থান উপযোগী হওয়ায় এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে আমের স্থায়ী রপ্তানি বাজার রয়েছে এবং এথনিক ও নিচি মার্কেটের সুবিধাও রয়েছে। বিধায় বর্তমানে বিদেশে আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি রপ্তানি ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় হতে হবে। আম রপ্তানির জন্য নিচের বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ-
১. বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;
২. বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমের মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
৩. সরকারি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রেরণের মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;
৪. বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো;
৫. আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান করা;
৬. পরিবহন বিমানের ব্যবস্থা ও ভাড়ার হার সহনীয় রাখা;
৭. বিদেশে রপ্তানির জন্য শুল্ক না নেয়া;
৮. আমকে বিদেশে সম্প্রসারণ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং
৯. আম রপ্তানির জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা।
লেখক:
ড. মো. জমির উদ্দিন*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ