আমের বাম্পার ফলন পেতে করণীয়
- Published Date
- Written by Super Admin
- Hits: 59598
আমকে বলা হয় ফলের রাজা। এ ফলটি সাধারণত উষ্ণ ও অউষ্ণম-লীয় অঞ্চলের। ইন্দো-বার্মা অঞ্চল আমের উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয়। তবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয়।
আমকে বলা হয় ফলের রাজা। এ ফলটি সাধারণত উষ্ণ ও অউষ্ণম-লীয় অঞ্চলের। ইন্দো-বার্মা অঞ্চল আমের উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয়। তবে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয়।
কারণ, এ ফলটির পুষ্টিমান ও স্বাদ এবং গন্ধ অতুলনীয়। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে আম জন্মে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে আম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
আম চাষিরা প্রতিবছর ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন সাধারণত দুই ধরনের সমস্যার কারণে। এগুলো হলো- (অ) প্রাকৃতিক কারণ (যেমন- ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি) এবং (আ) রোগ ও পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে।
সঠিক পরিচর্যা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে চলতি মৌসুমে আম গাছে ব্যাপকহারে মুকুল এসেছে। বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই মোকাবিলা করে আমের বাম্পার ফলন পেতে কৃষকদের নিম্নলিখিত পরামর্শ প্রদান করা হলো।
(অ) ফলন্ত আম গাছের পরিচর্যা : আম গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ফলন বাড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত পরিচর্যাগুলো একান্ত প্রয়োজন।
পরগাছা দমন
আমগাছে একাধিক জাতের পরগাছা জন্মে। এসব পরগাছা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরগাছাসমূহে শিকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া হয়, যা গাছের মধ্যে প্রবেশ করে রস শোষণ করে এবং দুর্বল করে। পরগাছার প্রাদুর্ভাব বেশি হলে গাছের পাতার আকার ছোট ও ফ্যাকাসে হয় এবং অনেক সময় গাছ মারা যেতে পারে। এর ফলে গাছের ফলন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। তাই ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই পরগাছা অপসারণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ
গাছের বৃদ্ধি ও ফল উৎপাদনের জন্য সারের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। ফলন্ত গাছের আকার, বয়স ও মাটির উর্বরতার ওপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। দুপুর বেলা যতটুকু স্থানে ছায়া পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কুপিয়ে সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ
সাধারণত জমির ওপর স্তরে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান থাকে। তাই আম বাগানের ওপরের দুই থেকে তিন মিটার অংশকে জমির পানি সংরক্ষণ স্তর হিসেবে ধরা হয়। শুষ্ক মৌসুমে আম বাগানে পানি সেচ দেয়া দরকার। আমের গুটি মটর দানার মতো হওয়ার পর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর দইি থেকে তিনবার সেচ দিলে আমের গুটি ঝরা বন্ধ হয়।
বয়স্ক টক আমগাছকে মিষ্টি আমগাছে রূপান্তরকরণ
বাগানের কোনো গাছের আমের গুণাগুণ খারাপ হলে সে গাছকে নষ্ট না করে ভিনিয়ার কলমের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করা য়ায়। বয়স্ক গাছের দুই থেকে তিনটি ডাল কেটে দিলে সেখান থেকে নতুন শাখা বের হলে তারপর নতুন শাখাতে ভিনিয়ার কলম করে নিতে হবে। এভাবে তিন থেকে চারবার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
পুরাতন বাগান নবায়ন
আম বাগানের বয়স বেশি হলে ফল ধারণ কমে যায়, তাই এক্ষেত্রে গাছ কেটে না ফেলে পুরাতন গাছের ভারী শাখা কেটে দিলে সেখানে নতুন শাখা বের হবে এবং গাছ নবায়ন হয়ে যাবে। এভাবে দুই থেকে তিন বছরে বাগান নবায়ন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ
ফল ধরার তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই জাত ভেদে ফল পাকা শুরু করে। বাণিজ্যিক কারণে সম্পূর্ণ পাকা আমগাছ থেকে পাড়া ঠিক নয়। গাছের ফল দুই চারটি পাকা শুরু করলে লম্বা বাঁশের মাথায় থলে সদৃশ্য জালতি লাগিয়ে আম পাড়তে হবে যেন আঘাত না লাগে। গাছের নিচে সাময়িকভাবে রাখতে হলে খড় বিছিয়ে তার ওপর রাখতে হবে। কিছু লক্ষণ দেখে ফল সংগ্রহ করতে হবে। যেমন- (১) আমের বোটার নিচে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। (২) পানিতে দিলে ডুবে যাবে। (৩) কষ বের হলে দুধ শুকে যাবে। (৪) দুই একটি পাকা আম গাছ থেকে ঝরে পড়বে।
ফল সংরক্ষণ
আম পচনশীল ফল। বেশি পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করলে সংরক্ষণকাল কম হয়। অধিকাংশ জাতের আম ১৩-১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ও ৮৫-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় বাঁশের ঝুড়ি, বাস্কেট ও খড়বিছানো অবস্থায় চার থেকে সাত সপ্তা সংরক্ষণ করা যায়।
(আ) রোগ দমন
অ্যানথ্রাকনোজ (অহঃযৎধপহড়ংব)
এ রোগ আমের পাতা ও ফলে হয়ে থাকে। রোগটি কোলিটোর্টিকাম গোলেসপোরিওডিস (ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস মষড়বড়ংঢ়ড়ৎরড়রফবং) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগের কারণে আমের ফলন শূন্যের কাছাকাছি আসতে পারে।
লক্ষণসমূহ
(১) এ রোগ নতুন পাতা, পু®পমঞ্জুরী ও ফলে দেখা যায়। (২) পাতায় ধূসর-বাদামী ছোট কৌষিক দাগ পড়ে এবং পরে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে ও এক পর্যায়ে পাতা ঝরে পড়ে। (৩) ফলের ওপর প্রথমে গাঢ় বাদামি দাগ পড়ে। (৪) দাগগুলো পরে বড় হয়ে কাল বর্ণ ধারণ করে। (৫) আক্রমণ মারাত্মক হলে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ আম পচে যায়।
অনুকূল অবস্থা
(১) তাপমাত্রা ২৫Ñ২৮ ডিগ্রি সে.। (২) আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০-৮০%। (৩) অধিক বৃষ্টিপাত। (৪) ঘন কুয়াশা ও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ায়।
দমন ব্যবস্থা
(১) ফল সংগ্রহের পর বাগানের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে। (২) স্বাস্থ্যবান গাছ রোপণ করতে হবে। (৩) বোর্দো মিক্সসার ০.৩% হারে তিন থেকে চারবার ¯েপ্র করতে হবে (ফুল ধরার পূর্বে ও পরে এবং ফল সংগ্রহের পূর্বে)। (৪) বাভিসটিন ডব্লিউ/পি ০.২ % হারে অথবা ডাইথেন-এম ০.৩ % হারে দুই বার (ফুল ধরার পূর্বে ও পরে ) ¯েপ্র করতে হবে।
আমের বোটা ও ফল পচা (ঝঃবস বহফ ৎড়ঃ)
রোগের কারণ
এ রোগ বোর্টিডিপ্লডিয়া থিয়োবোরমি (ইড়ঃৎুড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ রোগ আমের বোটা ও ফলে হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণসমূহ
(১) প্রথমে বোঁটার চতুর্দিকে কিছু জায়গাজুড়ে কাল দাগ পড়ে। (২) পরবর্তীতে আমের অধিকাংশ ও সর্বশেষ অংশ পচে কাল রঙ ধারণ (৩) আক্রান্ত স্থানে চাপ দিলে ভেতর থেকে পচা কালো গন্ধযুক্ত আমের রস বের হয়ে আসে।
রোগ দমন
(ক) যেকোনো একটি পদ্ধতিতে রোগ দমন করতে হবে। যেমন- (১) ডাইথেন-এম-৪৫, ০.৩% হারে দুই থেকে তিনবার ¯েপ্র করতে হবে। (২) রিডোমিল ০.১ % হারে দুই থেকে তিনবার ¯েপ্র করতে হবে। (৩) রোভরাল ০.১ % হারে দুই থেকে তিনবার ¯েপ্র করতে হবে।
(খ) আম হারভেস্ট করার পর ৪৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় পাঁচ মিনিট ৬% বোরাক্স দ্রবণে চুবাতে হবে।
(গ) ফল সংগ্রহ করার পর ডালপালা, অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে।
আমের পাউডারি মিলডিউ (চড়ফিবৎু সরষফবি ড়ভ সধহমড়)
রোগের কারণ : এ রোগ ওডিয়াম মেংগিফেরা (ঙরফরঁস সধহমরভবৎধব) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণসমূহ
(১) পু®পমঞ্জুরী ও এর সংলগ্ন কচিপাতা এবং ছোট ফলের ওপর সাদা-ধূসর পাউডার দেখা যায়। (২) সাধারণত সংক্রামণ পু®পমঞ্জুরী অগ্রভাগে ক্ষত শুরু করে নিচের দিকে ধাবিত হয় এবং কুচকে গিয়ে ডাই-বেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। (৩) ফল অপরিপক্ব অবস্থায় ঝরে পড়ে এবং বিকৃত ও বিবর্ণ হয়।
দমন ব্যবস্থা
(১) আমের বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। (২) ছত্রাকের গঠন ধ্বংস করতে মাঝে মাঝে গাছে পানি ¯েপ্র করতে হবে। (৩) থিয়োভিট ০.৩% হারে ফুল ফোটার পূর্বে একবার ও পরে দুইবার ¯েপ্র করতে হবে। (৪) ম্যালাথিয়ন ০.২ % হারে ফুল ফোটার পর একবার ও গুটি আসার পর ১৫ দিন পর পর দুইবার ¯েপ্র করতে হবে।
(ই) পোকামাকড় দমন
আমের শোষক পোকা/ আমের হপার (গধহমড় যড়ঢ়ঢ়বৎ)
এই পোকার তিনটি প্রজাতি ক্ষতি করে থাকে। নিম্নে ক্ষতির প্রকৃতি ও দমন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ক্ষতির প্রকৃতি
আমের অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে এ পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে থাকে। আমের পাতা ও বোঁটায় এরা ডিম পাড়ে। এজন্য আক্রান্ত পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং গুটি আসার পূর্বেই ফুল ঝরে য়ায়। এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এ পোকার আক্রমণের অন্যতম লক্ষণ হলো, আক্রান্ত গাছের নিচে দিয়ে হাঁটলে পোকা লাফিয়ে গায়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা
এ পোকা দমন করতে হলে মুকুল আসার আগে অথবা মুকুল আসার মুহূর্ত থেকে নিম্নলিখিত কীটনাশক ¯েপ্র করতে হবে-
ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লেবাসিড ৫০ ইসি চা চামচের ৪ চামুচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দুইবার ¯েপ্র করতে হবে। অথবা ম্যালাথিয়ন বা এমএসটি ৫৭ ইসি উপরোক্ত মাত্রায় ¯েপ্র করতে হবে।
ফলের মাছি বা আমের মাছি পোকা (গধহমড় ভৎঁরঃ ভষু)
ক্ষতির প্রকৃতি
এ পোকা পাকা আমের মধ্যে প্রবেশ করে শাঁস খেয়ে ফেলে। এতে ফল পচে যায় ও ঝরে পড়ে। আক্রান্ত আম কাটলে অসংখ্য পোকা দেখা য়ায়। পোকার আক্রমণ বেশি হলে গাছের সমস্ত আম খাওয়ার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা
আম পাকার পূর্বে যখন পূর্ণ বৃদ্বিপ্রাপ্ত হয় ডিপটেরেক্স চা চামচের চার চামচ ৮.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে সাতদিন পর পর দুইবার ¯েপ্র করতে হবে। অথবা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ২মিলি/লিটার পানিতে মিশে ফলে ¯েপ্র করতে হবে ( এসময়ে ফল খাওয়া যাবে না)।
আমের বিছা পোকা (গধহমড় ফবভড়ষরধঃড়ৎ)
ক্ষতির প্রকৃতি
এ পোকা আমগাছের পাতা খেয়ে ফেলে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায় এবং ফুল-ফল হয় না বা হলেও ঝরে পড়ে। তবে কোনো গাছ একবার আক্রান্ত হলে বারবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দমন ব্যবস্থা
আক্রান্ত গাছে ডাইমেক্রম ১০০ ইসি ৩০০ মিলি বা ডায়াজিনন ৫০ ইসি ৪০০ মিলি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ৪৫৪ মিলি ২২৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
Comments
- No comments found
Leave your comments