সারা বছর চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কোথাও বেড়ানো সম্ভব হয় না। তাই এবারে ঈদের ছুটিটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। পারিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটে এলাম শিক্ষা নগরী রাজশাহী শহরে। উদ্যেশ্য ছিল চাঁপাই নবাবগঞ্জে বস্থিত সুলতানী আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি সোনা মসজিদ দেখব। এবারই প্রথম আসা হল রাজশাহীতে। স্বভাবতই ঈদের দিন সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে ঘর থেকে বের হতে পারিনি। তাই বেড়ানোর ও ঈদের আনন্দ উপভোগের সুযোগ হয়নি প্রিয়জন নিয়ে। কিন্তু ঈদের পরদিন বৃষ্টি বন্ধ হলে সৌন্দর্য্য ও ভ্রমণ পিয়াসী আমি আর ঘরে বসে থকতে পারিনি। তাই শিক্ষাও প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের নগরী রাজশাহীর উদ্দ্যেশ্যে ২১ আগষ্ট রাত ১১ টায় চট্টগ্রাম রেলষ্টেশন থেকে তূর্ণা নিশিতা ট্রেনে করে রওয়ানা দিলাম। রাত গড়িয়ে পরদিন ভোর ৬ টায় ঢাকা বিমান বন্দর ষ্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে নেমে তাড়াহুড়া করে আবার টিকেট করলাম রাজশাহীর। ভাগ্য ভাল যে ট্রেনে সিট ওয়ালা টিকেট ও পেয়ে গেলাম। সকাল সাড়ে ৬ টায় ধুমক্ষেতু ট্রেন বিমান বন্দর ষ্টেশন থেকে রাজশাহীর উদ্দ্যেশ্য ছেড়ে দিল। একে এক সাভার গাজীপুর টাঙ্গাইল, যমুনা ব্রীজ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, পার হয়ে বেলা ১ টায় রাজশাহী শহরে পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে নেমে শহরের মহিষবাথান এলাকায় এক আত্নীয়ের বাড়ীতে উঠলাম। ওখানে রাত্রি যাপন করে পরদিন সকাল ৯ টায় শহরের কোট ষ্টেশন থেকে বাসে উঠলাম সুলতানী আমলে নির্মিত ৫শত বছরের পুরানো ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ দেখার জন্য। বাসটি গোড়াগাড়ী উপজেলা, চাঁপাই শহর, মহানন্দা নদীর চীনমৈত্রী সেতু পার হয়ে শিবগঞ্জ ও কানসাট ষ্টেশন ফেলে এক সময় সোনা মসজিদ পৌঁছলাম। রাজশাহী থেকে সোনা মসজিদ পৌঁছতে সময় লাগে দুঘন্টা । দুরত্ব ৮৪ কিঃমিঃ। গাড়ী চলন্ত অবস্থায় শুধু গাড়ী থেকে দেখাগেল সড়কের দু পার্শ্বে বিশাল বিশাল আমের বাগান কানসাটে দেখলাম বিশাল আমের বাজার। লোকজন ভ্যানগাড়ীতে করে আমের টুকরী কানসর্ট বাজারে নিয়ে আসছে। আমরা সোনা মসজিদ যখন পৌছলাম তখন গাড়ীর হেলপার সোনা মসজিদ সোনা মসজিদ বলে ডাকদিলে আমরা গাড়ী থেকে নেমে পড়ি। নেমেই দেখি সড়কের ডান পাশে চতূর্দিকে বাউন্ডারী ওয়াল ঘেরা ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ। মনভরে দেখতে লাগলাম ঐতিহাসিক সোনা মসজিদটি। এতদিন শুধু বইতে পড়েছি এবার বাস্তবে দেখা মিলল। খুবই সুন্দর সোনা মসজিদটি। এখানকার প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাস সূত্রে জানা যায় প্রাচীন জনপদ গৌড় বিভিন্ন সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল। ফলে সে সময় এ অঞ্চলে বহু আবকাঠামো গড়ে উঠে বিশেষ করে সুলতানী ও মুগল আমলে বহু মসজিদ, মাদ্রসা এবং আন্যান্য ইমারত নির্মিত হয়। তৎমধ্যে ছোট সোনা মসজিদ অন্যতম। রাজশাহী শহর থেকে ৮৪ কিঃমিঃ উত্তর পশ্চিমে ও চাঁপাইনবাব গঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৬ কিঃমিঃ উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজ পুর ইউনিয়নে অবস্থিত সোনা মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। আয়তকারে নির্মিত এ মসজিদের পরিমাপ দৈর্ঘ্য ২৫ মিটার, প্রস্থ ১৬ মিটার। মসজিদের দেয়াল পাতলা ইটের তৈরী এবং দেয়ালের উভয় পাশে শ্বেতপাথর দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আবৃত। পূর্ব দেয়ালে ৫টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৩টি করে ৬টি মোট ১১টি খিলান প্রবেশ পথ। প্রতিটি দেয়ালের প্রস্থ সাড়ে ৩ ফিট। তাছাড়া পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে কারুকার্যময় পাথরের তৈরী ৫টি অত্যান্ত চমৎকার মিহরাব। মসজিদের উত্তর ও পশ্চিম কোণে অলংকৃত স্তম্ভের উপর রয়েছে কথিত টঢধণ্র ঐটফফণরহ বা বাদশা-বা তকত। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি অষ্টকোণকৃতির মিনার বা টারেট এবং উপরে ১২টি অর্ধগোলাকৃতির ও ৩টি চৌচালা আকৃতির ১৫টি গম্বুজ আছে। গম্বুজগুলোতে এক সময় সোনার গ্রিল্ড করাছিল বলে জানাযায়। ভিতরে রয়েছে কারুকার্য খচিত ১৫টি পিলার। ফলে মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে সোনা মসজিদ । যেহেতু গৌড় দূর্গে (ভারত) অবস্থিত বড় সোনা মসজিদের তুলনায় আকারে ছোট তাই এটি ছোট সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। সোনা মসজিদের মূল আকর্ষণ দেয়ালের বাইরের নান্দনিক অলংকরন। বিশেষ করে দেয়ালের বহিরাংশে পাথরের উপর পোড়া মাটির ফলকের অনুকরনে লতা-পাতা, ফুল, ঝুলন্ত শিকল ও ঘন্টা ইত্যাদি অলংকরণ শোভিত হয়েছে। মসজিদের ভিতরের মেঝে ও আঙ্গিনায় নকসাঙ্কিত চকচকে টালি বসানো ছিল। মসজিদের সামনে বিশাল উঠান ও এরপর একটি চমৎকার খিলান যুক্ত তোরণ আছে।
স্থাপত্য কলাও শৈল্পিক সৌন্দর্য্যের বিচারে মসজিদটি গৌড়ের রত্ন হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রিয় দরজার উপর স্থাপিত শিলা লিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মোহাম্মদ কর্তৃক ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রীষ্টাদ্বের মধ্যবর্তী মসয়ে নির্মিত। (বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কৃর্তক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। মসজিদের বাউন্ডারী ওয়ালের ভিতরে পূর্ব ও দক্ষিন কোণে রয়েছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী বাংলার কৃতি সন্তান বীর শ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেনেট শহীদ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধিস্থল।
সোনা মসজিদ দেখা শেষ হওয়ার পর ভ্যানগাড়ীতে চড়ে চলে গেলাম ঐতিহাসিক নিদর্শন তাহাখানায়। ছোট সোনা মসজিদ থেকে প্রায় অর্ধ কিঃ মিটার উত্তর পশ্চিমে জাহেদুল বালা নামের দিঘীর পাড়ে তাহখানার অবস্থান। দ্বিতল বিশিষ্ট এ ইমারতটির পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৩৫.৩৫ মিটার, প্রস্থ ১১.৫৮মিঃ। উত্তর পূর্ক ও দক্ষিণ পূর্ব কোণায় দুটি অষ্টকোণকৃতির কক্ষসহ উপর তলায় মোট ১৭টি কক্ষ আছে। উত্তর পাশের কক্ষটি নামাজ কক্ষ এবং অন্যান্য কক্ষগুলো দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে যেমন ক্ষৌরকর্ম, বিশ্রাম আপ্যায়ন, ভোজনালয় গোসল ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হতো। দক্ষিণ পার্শ্বে গম্বুজ আকৃতির হাম্মামখানা অবস্থিত। দক্ষিণ পূর্ব কোণায় অবস্থিত একটি সিঁড়ি পুকুর পর্যন্ত ধাবমান রয়েছে। খাম্মাম খানাও প্রসাধনাগারে মাটির পাইপের গরম ও ঠান্ডাপানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়। চুন-সুরকির সাহায্যে ছোট আকৃতির ইট দ্বারা নির্মিত এ ইমারতরে ভিতরের দেয়াল পাত্রে কুলঙ্গি সহ অন্যান্য নঁকশা রয়েছে। ইমারত টি ব্যবহার সম্পর্কে জানাযায় প্রথমত শাহসুজা এলাকা পরিদর্শনে ও তার আধ্যাত্মিক গুরু শাহ নিয়ামত উল্লাহ (রঃ) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে এখানে অবস্থান ও রাত্রি যাপন করতেন। দ্বিতীয়ত:- আধ্যাত্মিক গুরু শাহ নিয়ামত উল্লাহ (রঃ) এর বসবাসের নিমিত্তে শাহসুজা খ্রী: ১৬৫৫ সালে এটি নির্মাণ করেন। এ ইমারতের উত্তর পশ্চিমে মোগল আমলের একটি মসজিদ এবং উত্তরে শাহ নিয়ামত উল্লাহ (রঃ) এর মাজার অবস্থিত।
সোনা মসজিদ থেকে প্রায় ১ কিঃ মিঃ ও শাহ নিয়ামত উল্লাহ(রঃ) এর মাজার থেকে প্রায় আধা কিঃ মিঃ উত্তরে ভারত সীমান্তে অবস্থিত সোনা মসজিদ স্থল বন্দর। এপারে বিজিবি ও ওপারে রয়েছে বিএসএফ। আমরা বিজিবি থেকে অনুমতি নিয়ে ১০ মিনিটের জন্য জিরো পয়েন্টে যায়। দেখাগেছে ভারতের মালবাহী গাড়ীগুলো চেকপোষ্ট অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ গাড়ী গুলো ুআদা, হলুদ, পিয়াজ, রসুন, ডাল, চুলা, গম, পাথর, ইত্যাদি নিয়ে আসছে। এদৃশ্যটি খুবই সুন্দর লাগল। আপনিও একবার দেখে আসুন সোনা মসজিদ।
আয়েশা বেগম মিনার
শিক্ষক