খুলনা শহর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরের বান্দা গ্রাম। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া বাসস্টান্ডে নেমে উত্তর দিকে আড়াই কিলোমিটার পরেই বান্দা। এ গ্রামেরই একজন অশোক বৈরাগী। নতুন নতুন জাতের আমের কলম তৈরি করে তিনি আজ সফল নার্সারি ব্যবসায়ী। আমের কলম তৈরি করা এখন তাঁর নেশা। এক গাছে ২১৭ জাতের আমের কলম তৈরি করে বিশেষ সফলতা দেখিয়েছেন। নিরলস চেষ্টায় তাঁর শ্রীহীন সংসারেও এখন ঝলমলে আলো।
অশোক বৈরাগী স্বপ্ন দেখেন, একটি গাছে ৩০০ জাতের আম ফলাবেন। সেই চেষ্টাই চলছে। ১৯৮৮ সালে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জমিতে শতাধিক আমের কলম নিয়ে তিনি নার্সারি শুরু করেন। ওই কলম কিনে এনেছিলেন সাতক্ষীরা থেকে। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে যান নার্সারি ব্যবসায়ী। প্রথম পর্যায়ে আমের কলম দেখে কোনটি কোন জাতের, তা চিনতেন না। পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে নাম শুনে শুনে গাছের গায়ে লিখে ঝুলিয়ে রাখতেন। এখন গাছের পাতা দেখে আমের জাত শনাক্ত করতে পারেন।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরার আজাদ নার্সারিতে আমের কলম উৎপাদন করা দেখে এ কাজে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়। নার্সারি এলাকা বলে পরিচিত ফুলতলার বেজেরডাঙ্গার অনেক নার্সারির মালিক এখন তাঁর কাছ থেকে আমের কলম নেন, বীজ ও চারা সংগ্রহ করেন। পরিত্যক্ত জমির ওপর গড়ে তোলা নার্সারি এখন আড়াই বিঘা জমিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। কলমের পরিমাণ আট হাজার। চলতি মৌসুমে তিনি পাঁচ হাজার কলম বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এতে আয় হবে তিন লাখ টাকার বেশি।
অশোক নার্সারি। এখন তাঁর নার্সারিতে প্রায় ২৫০ প্রজাতির আমের চারা রয়েছে। লক্ষ্য, ৩০০ জাতের আমের চারা সংগ্রহ করা। নতুন জাতের আমের কথা জানতে পারলেই চলে যান সেখানে। সংগ্রহ করেন এবং তা থেকে নতুন নতুন চারা তৈরি করেন। সৌদি কুইন জাতের বীজটি তিনি সংগ্রহ করেন বটিয়াঘাটা এলাকার জনৈক সৌদি প্রবাসী ব্যক্তির কাছ থেকে। এ জাতের একটি আমের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি। নাম্বার-১০ আমের প্রতিটির ওজন তিন কেজির কাছাকাছি। এ ছাড়া তাঁর নার্সারিতে মোহনভোগ, চিনিটুরি, আমেরিকান কেইন, বেলখাশ, হলুদ কাশ, চায়না ফজলি, চোষা, ভাজতারা, মাদ্রাজি, দমদম মিছরি ও নানিতাল জাতের আমের চারা পাওয়া যায়। আর এসব জাতের অধিকাংশই এখন ফলবতী। অনেক আমের চারার নাম আবার নিজেই দিয়েছেন। নামকরণ করেছেন পাতালপুরী আম। বৈশিষ্ট্য, যত উঁচুতেই এ আম হোক না কেন, তার বোঁটা লম্বা হয়ে নিচের দিকে যেতে চায়; মনে হয় পাতাল দেশই তার গন্তব্য।
অশোক নার্সারিতে এখন একদিকে পাকা আম, কাঁচা আম আবার মুকুলের ছড়াছড়ি। এবার তিনি গোপালভোগ ও দুধসাগর জাতের সম্মিলন (ক্রস) ঘটিয়ে ভিন্নধর্মী নতুন স্বাদের একটি আমের জাত তৈরি করেছেন। নিজের নামেই এর নামকরণ করেছেন 'অশোকা' আম্র। যেকোনো জাতের প্রতিটি আমের কলম রোপণ উপযোগী করে তুলতে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, যার প্রতিটির বাজারমূল্য ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ব্যতিক্রমী জাতের কিছু চারার দাম তুলনামূলক বেশি। একসময়ের হতদরিদ্র অশোক বৈরাগীর নার্সারিতে এখন পাঁচ থেকে সাতজন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করেন। নার্সারির প্রধান শত্রু কলমে পাতা মোড়ানো ও কাণ্ড ছিদ্র করা পোকার আক্রমণ। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য তিনি রেলোথ্রিন-১০সি নামের ভারতীয় কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন।
নিজের চেষ্টা ও আগ্রহে অনেকের কাছ থেকেই তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। কলম তৈরির কলাকৌশল শেখার জন্য তিনি রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া ভারতের বশিরহাট থেকে এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে কৃষি বিভাগের প্রতি তাঁর বেজায় ক্ষোভ। এ প্রসঙ্গে বলেন, 'নার্সারি করতে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে নূ্যনতম কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।' তিনি মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে এবং পরিস্থিতির চাপে শিখেছেন।
এখন তাঁর নার্সারি থেকে প্রচুর চারা বিক্রি হয়। লাভও হয়। নিয়মিত বৃক্ষমেলায় অংশ নেন। পুরস্কারও পেয়েছেন।
Published in
আলোচিত খবর
Latest from Super Admin
Leave a comment
Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.