আম অতি সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় দেশীয় ফল। পুষ্টি বিবেচনায় এ ফলের অবস্থান বেশ ওপরে। আমকে বলা হয় ফলের রাজা। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। জাতীয় আয়ের প্রধান অংশই আসে কৃষি থেকে। কাজেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে সূদৃঢ় ও সুসংহত করতে আমের অধিক উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ একান্ত অপরিহার্য। সঠিক সময়ে আমগাছের পরিচর্যা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন করে অনেকাংশে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের দ্বারা বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন- সার ও সেচ প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা, রোগ ও পোকামাকড় দমন ইত্যাদি উদ্ভাবন আমচাষিদের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। আগে আম চাষে তেমন কোনো বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা না হলেও বর্তমানে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করার ফলে উৎপাদনও বেড়েছে। এখনো কিছু কিছু আমচাষি আম মৌসুমের প্রথম থেকে আম বড় হওয়া পর্যন্ত কোন কাজটি কোন সময়ে করতে হবে তা সঠিকভাবে না জানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। সুতরাং আমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সবারই সচেষ্ট হওয়া একান্ত দরকার।
উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ
শুষ্ক, ঊষ্ণ ও আর্দ্র সব অঞ্চলেই আম কম বেশি জন্মাতে পারে। তবে আমের জন্য সবচেয়ে ভালো শুষ্ক আবহাওয়া । তবে পুষ্পায়নের সময় ঠাণ্ডা আবহাওয়া দরকার। আবার খুব বেশি ঠাণ্ডা হলেও ভালো না, তাহলে বাডগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকার ফলে মুকুল বের হয় না। একটু গরম পেলে মুকুল বের হতে শুরু করে। ফল ধারণের সময় ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং ফলের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার জন্য গরম আবহাওয়া দরকার। আমগাছে মুকুল আসার সময় আকাশ বেশ পরিষ্কার থাকা ও কুয়াশা না হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কারণ বৃষ্টিপাত ও কুয়াশা আমের মুকুলের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকারক। কিন্তু ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস আম উৎপাদনের জন্য বড় সমস্যা। কারণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই দুই মাসে আবহাওয়া খুব একটা ভালো থাকে না। প্রায়ই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। রোদ থাকে না বরং কুয়াশায় আকাশ ঢাকা থাকে। এতে স্ত্রী শোষক (হপার) পোকা ডিম পেড়ে অসংখ্য পোকার সৃষ্টি করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এ পোকা ছাড়াও মিলিবাগ ও স্কেল ইনসেক্ট মধুজাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে ফলে শুঁটিমোল্ড রোগ দেখা দেয়। এ রোগের ফলে গাছের পাতার ওপর কালো আবরণ পড়ে। অনেক সময় শাখা ও পরিপুষ্ট আমের গায়েও কাল আবরণ দেখা যায়। এই কালো আবরণ হলো ছত্রাকদেহ ও বীজকণার সমষ্টি।
এ রোগ গাছের খাদ্য উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় এবং এতে আমের গাছ দুর্বল হয়, আমের ফলন অনেকটা কম হয় এবং মান কমে যায়। তাই এ সময় গাছের কান্ডে ও পাতায় সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/রেলথ্রিন/সাইথ্রিন ইত্যাদি) ১মিলি./লিটার অথবা সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশেয়ে স্প্রে করতে হবে। এবং মুকুল বের হয়েছে কিন্তু ফুল ফোঁটার আগে (পুষ্প মঞ্জরির দৈর্ঘ্য ৫-১০ সেমি. হলে) একই ওষুধ এবং তার সাথে ছত্রাকনাশক ডায়থেন এম-৪৫, ২ গ্রাম/লিটার অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া পাউডারি মিলডিউ যাতে মুকুল নষ্ট করতে না পারে তার জন্য এ মাসের শেষ সপ্তাহে একবার সালফার ঘটিত ছত্রাকনাশক (থিওভিট ২ গ্রাম/ লিটার) স্প্রে করতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে তাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমের মুকুলের কুঁড়িগুলো বের হয় এবং অনেক সময় মেঘলা আকাশ ও কুয়াশা থাকার কারণে মুকুলে পাউডারি মিলডিউ রোগ দেখা দেয়। ফলে অতি দ্রুত মুকুলের গায়ে সাদা সাদা পাউডারের মতো দেখা দেয়। থিওভিট প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে তা দমন করা যায়। অথবা সালফারের গুঁড়া বা দ্রবণ (০.২%) স্প্রে করলেও এ রোগের প্রকোপ কমে যায়। তাছাড়া অ্যানথ্রাকনোজও এ সময় দেখা দেয়। ফলে সব মুকুল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। কাজেই ডায়থেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। গাছে স্ত্রী শোষক (হপার) পোকা দেখা গেলে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/লেথ্রিন ইত্যাদি) ১ মি: লি:/ লিটার অথবা সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা দরকার। তবে শোষক (হপার) পোকার সাথে ছত্রাকজাতীয় রোগ দমনের জন্য কীটনাশকের সাথে ছত্রাকনাশক মিশিয়ে স্প্রে করলে আমের ভালো ফলন পাওয়া যায়। যদি এ মাসে ফলের গুটি মটর দানার মতো হয় এবং ফল বেশি করে ঝরে পড়লে তা রোধের এবং আকার বৃদ্ধির জন্য প্ল্যানোফিক্স ২ মিলি ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে ভালোভাবে স্প্রে করা উচিত।
মার্চ মাস থেকে শুরু করে এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড খরা অর্থাৎ উচ্চ তাপমাত্রা (৩১.৫ সে: বা তার ঊর্ধ্ব), আর্দ্রতা (৮০-৮৫%) এবং মাঝে মাঝে বৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব থাকার কারণে প্রায় ছোট ও বড় সব জাতের আমগাছ আগামরা ও আঠাঝরা রোগে আক্রান্ত হয়। যেহেতু মরা ডাল ও পাতায় রোগের জীবাণু থাকে কাজেই বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে। যেহেতু পানির অভাবে অনেকাংশে এ রোগ হয় তাই এ সময় গাছে প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে পানির আভাব দূর করতে হবে। তাছাড় অনেক সময় এ মাসে ফল ধারণের পর থেকে ফল মটর দানা হওয়া পর্যন্ত শোষক (হপার) পোকা আক্রমণ করে থাকে। ফলে পূর্বের মতো আবার দ্বিতীয় বার শোষক (হপার) দমন করতে হবে। কিন্তু যদি কোন কারণে মুকুল দেরিতে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে আসে তবে এ ক্ষেত্রে ওষুধ ছিটানো প্রথমবার হওয়া উচিত। এমাসে আবহাওয়া বেশ শুষ্ক ও উত্তপ্ত হয়ে থাকে তাই কচি আমের আকার যখন মটর দানাদার সমান হবে তখন ফলের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য অন্তত একবার সেচ দেয়া প্রয়োজন। এমাসেই ফলন্ত গাছ থেকে নষ্ট ও বিকৃত পুষ্প মঞ্জরি ছাঁটাই করা প্রয়োজন। দেরিতে ফুল আসে এমন আম গাছে যদি অ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ দেখা যায় তবে সঠিক ছত্রাকনাশক স্প্রে করা প্রয়োজন। এ মাসে ফলের গুটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। আর এপ্রিল-মে মাসে ফলপচা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সুতারাং ডায়থেন এম-৪৫ প্রতিরোধক হিসেবে স্প্রে করা প্রয়োজন। সেচের ব্যবস্থা থাকলে গাছে পরের অকার বৃদ্ধি করতে ও মান উন্নত করতে সুষম সার প্রয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন।
এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা আরও বাড়ে এবং আর্দ্রতা কমে। ডাইব্যাক ও গামোসিসরোগের হাত থেকে ফলন্ত আম গাছকে (বিশেষ করে ২-১০ বছর) রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সেচ পানির দরকার। ফল-পচা রোগের আক্রমণ দূর করতে ১৫ দিন পর পর দু’বার ছত্রাকনাশক ওষুধ যেমন- ডায়থেন এম -৪৫ ২ গ্রাম/রিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। কচি আমের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দমনের জন্য সুমিথিয়ন-৫০ ইসি ২ মিলি. হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের ডাল-পালা ও আম ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। যদি পাতায় রেড রাস্টের লক্ষণ দেখা দেয় তবে কপার-অক্সিক্লোরাইড (০.২%) বা বর্দো মিশ্রণ (১%) ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে ঝরে পড়ে থাকা আম সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে পেলা উচিত। এম মাসেই আম মার্বেল আকৃতির হয় এবং অনেক সময় বেশি করে ঝরে পড়তে থাকে। তাই এ মাসে ও প্ল্যানোফিক্স ২ মিলি ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালোভাবে গাছে স্প্রে করলে ফল ঝরা কমে যায় এবং ফলের আকার বৃদ্ধি পায়।
মে মাসে ও পাতায় রেড রাস্টের লক্ষণ যদি দেখা যায় তবে কপার-অক্সিক্লোরাইড (০.২%) বা বর্দো মিশ্রণ (১%) ছিটাতে হবে। এ মাসে আগাম জাতের আমে ফ্রুট ফ্লাই লাগতে পারে। কাজেই বিষটোপ/ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে। আগাম জাতের কিছু কিছু আম এ মাসেই পাকতে শুরু করে। ঝরে পড়া পাকা আম সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে পেলতে হবে। পাখি এবং বাদুর পাকা আম নষ্ট করে। তাই এদের প্রতি সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাছাড়া ফল-পচা রোগ দূর করতেও এ মাসে অন্তত একবার ডায়থেন এম-৪৫ স্প্রে করা উচিত। আমের আগাম জাত রয়েছে। এ মাসে সেগুলো পাকতে আরাম্ভ করে। আম সংগ্রহের পর গরম পানিতে (৫৫ সে. তাপমাত্রা) ৫ মিনিট ডুবিয়ে তারপর শুকিয়ে গুদামজাত করা দরকার অথবা ব্যাভিস্টিন দ্রবণে (১ গ্রাম/লিটার) ডুবিয়ে পরে শুকিয়ে রাখা উচিত।
জুন মাসে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হয়। তাই গাছের ভালো বৃদ্ধি হওয়ায় আমের পাতা কাটা উইভিল নতুন পাতা কেটে দিয়ে গাছের মারাত্মক ক্ষতি করে। কাজেই সেভিন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে দিয়ে স্প্রে করা উচিত। বেশির ভাগ আম এ মাসেই পাকে। আম সংগ্রহের পর রোগের হাত থেকে আমকে রক্ষার জন্য গরম পানিতে (৫৫ সে. ৫ মিনিট) ডুবিয়ে অথবা ব্যাভিস্টিন দ্রবণে (১ গ্রাম/লিটার পানিতে) ডুবিয়ে শুকানো উচিত। এ মাসেও ফ্রুট ফ্লাই ও রেড রাস্টের আক্রমণ হতে পারে। তাই মে মাসের ব্যবহৃত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। গাছ থেকে আম পাড়ার পর পরই যদি সুযোগ থাকে তবে গাছের মরা ডালপালা প্রুনিং করা উচিত এবং জমিতে ‘জো’ থাকলে প্রয়োজনীয় সার দেয়া উচিত। এ মাসে বৃষ্টির কারণে পরিপুষ্ট আমের গায়ে কালো দাগ হয়। কাজেই এ সময় ছত্রাকনাশক স্প্রে করা দরকার।
যেসব আম দেরিতে পাকে সেগুলোকে নাবি জাতের আম বলে এবং নাবি জাতের আম জুলাই মাসে পাকে। সাধারণত জুন মাসের চেয়ে জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। ফলে ছত্রাক রোগে ফল আক্রান্ত হয়ে বেশি পরিমাণে পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমগাছে ডায়থেন এম-৪৫, ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা উচিত। যদি পাতায় রেড রাস্ট থাকে তবে রোগের লক্ষণ দেখে প্রতি ১৫ দিন পর পর কপার অক্সিক্লোরাইড (০.২%), কুপ্রাভিট (০.২%) বা বর্দোমিশ্রণ (১%) স্প্রে করলে তা দমন হয়ে যাবে। অতিরিক্ত বর্ষার কারণে যদি জুন মাসে গাছে সার প্রয়োগ করা না হয়ে থাকে তবে আম পাড়ার পর এ মাসেও সার দেয়া যাবে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা কোনো স্থানের বৃষ্টিপাতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সারা দেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে অধিকতর আর্দ্রতা বিরাজ করে। আম পাকার সময় আর্দ্রতা বেশি থাকলে ফ্রুট+ফ্লাইয়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। কাজেই এ সময় আমগাছে ফ্রুট ফ্লাই বা ফলের মাছি পোকা দেখা যায়। আম মাছি পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পচে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়া আম সংগ্রহ করে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা উচিত। তাছাড়া মাছি পোকা দমনের জন্য বিষটোপ ব্যবহার করা অথবা ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়েও দমন করা যায়। আর যদি গায়ে কালো দাগ দেখা দেয় তবে জুন মাসের ব্যবহৃত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।