x 
Empty Product
Tuesday, 17 December 2019 08:17

মাত্র দুইজন বিজ্ঞানী দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণা কার্যক্রম

Written by 
Rate this item
(0 votes)

মাত্র দুইজন বিজ্ঞানী দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম গবেষণা কার্যক্রম। এ কারণে গবেষণার গতি অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা অনেকেই অবসরে, অনেকে ভিন্ন কেন্দ্রে ভিন্ন কোনো ফল-ফসলের গবেষণায় বদলিকৃত। ফলে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে গবেষণার ধারা। সেই সাথে বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা বহির্বিশ্বের সাথে প্রযুক্তি বিনিময় ও বিদেশ সফর না থাকায় দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণা উৎকর্ষতা লাভ করছে না।
১৯৮৫ সালে আম গবেষণা কেন্দ্র পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। একজন ভারতীয় বিজ্ঞানীসহ দেশীয় চারজন বিজ্ঞানীর মাধ্যমে গবেষণা যাত্রা শুরু করে। প্রারম্ভিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেন প্রথিতযশা আম বিজ্ঞানী ড. আবদুল জলিল ভূঁইয়া। প্রকল্পটি ১৯৯৯০ সালে আরো পাঁচ বছর মেয়াদে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ২০০১ সালে এটি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন এটিকে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে মৌলিকত্ব হারিয়ে আম ছাড়াও গবেষণায় স্থান পায় বিভিন্ন ফল-ফসল। এ সময় জনবল কাঠামোয় ১৪ জন বিজ্ঞানী কেন্দ্রে গবেষণার কাজ করতেন। পরে জনবল কাঠামোয় পরিবর্তন এনে পদের সংখ্যা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ জন বিজ্ঞানির পদ। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো ১০ জনের স্থলে বর্তমানে কর্মরত আছেন তিনজন। এর মধ্যে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদটি হচ্ছে প্রশাসনিক পদ। তাকে দাপ্তরিক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে দু’জন বিজ্ঞানী নির্ভর হয়ে পড়েছে আম গবেষণা কার্যক্রম। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র তথা আম গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: শফিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনিও জানান যে বর্তমানের জনবল দিয়ে গবেষণা ঠিকমতো চালানো যায় না।। তার ভাষায় গবেষণা থেমে নেই, তবে গতি অনেক ধীর। তিনি জানান, এ ধরনের গবেষণার জন্য কয়েক ধরনের লোকবল প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে হর্টিকালচারিস্ট,প্যাথলজিস্ট, কীটতত্ত্ববিদ, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনাবিদ ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানী। কিন্তু এখানে হর্টিকালচারিস্ট ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানী নেই। ফলে গবেষণা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করছে না। বিগত ২৫ বছরে এ কেন্দ্রে কীটতত্ত্ববিদ ছাড়াই চলছে কার্যক্রম। তিনি জানান, এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণালবদ্ধ জ্ঞান উন্নত বিশ্বের আম বিজ্ঞানীদের সাথে বিনিময়ের সুযোগ নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রিসার্চের বিজ্ঞানীদের বিদেশ ট্যুর নেই কিন্তু এক্সটেনশন বিভাগ ঠিকই বিদেশ সফর করছে। এই বৈষম্য থেকে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মনোবৃত্তি নষ্ট হচ্ছে। ভারত, পাকিস্থান, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম আম গবেষণায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় এখানকার অবস্থা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। জনবল সঙ্কটের বিষয়টি তিনি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন মহলে অবহিত করেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান।
গাছ আছে, আম আছে। শুধু নেই গবেষণা
আমের জাত উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশীয় জাতের সাথে বিদেশী জাতের হাইব্রিডাইজেশন বা শংকরায়ন নিয়ে ভারতীয় আম বিশেষজ্ঞ সিপিআইআর’র নেতৃত্বে একটি গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। ১৬টি শংকারিয়ত চারা নিয়ে গবেষণা শুরু হয় বলে জানা যায়। সেই গবেষণার হাল ধরেছিলেন ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বৈজ্ঞানিক কর্মকতা এবং বর্তমান প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃতী বিজ্ঞানী ড. জমির উদ্দিন। দীর্ঘ ১৭ বছর গবেষণার পর ২০০২ সালের অক্টোবরে হাইব্রিড ০১৭ নামের একটি নতুন জাত নিয়ে সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৩ এ সেটি বারি আম-৪ নামে জাত অবমুক্ত হয়। পরে আরো কয়েকটি রঙিন হাইব্রিড জাতের আম গবেষণায় সম্ভাবনা ও আগ্রহের সৃষ্টি করে। এগুলোর মধ্যে বেশি মিষ্টির হাই-০৫৮, কম মিষ্টির হাই-০৫৯, জুসের উপযোগী হাই-০৩৪ এবং বাইচান্স সিডলিং উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে বাইচান্স সিডলিং জাতটি নতুন রঙিন জাত হিসেবে অবমুক্তির তালিকায় স্থান পেলেও অজ্ঞাত কারণে সে প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। অন্য তিনটি রঙিন জাতের গাছ গবেষণা মাঠে রয়েছে। এ বছর ফলও ধরেছে। ড. জমির উদ্দিন অন্য কেন্দ্রে বদলি হয়ে যাওয়ায় গবেষণা যায় থেমে। অবশ্য রঙিন জাত নিয়ে গবেষণার কোনো অগ্রগতি না থাকা সত্ত্বেও গবেষণা থেমে থাকার বিষয়ে একমত হননি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। আশার কথা হলো মাঝখানে এই বিজ্ঞানী কেন্দ্রচ্যুত হলেও আবারো কেন্দ্রে ফিরে এসেছেন এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে সম্প্রতি যোগদান করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, দীর্ঘ গবেষণার ধারাবাহিকতায় এ কেন্দ্র থেকে এ পর্যন্ত আমের ৮টি জাত অবমুক্তি হয়েছে। এ গুলো হলোÑ বারি-১ (সিলেকশন), বারি-২ (সিলেকশন), বারি-৩ (প্রবর্তিত), বারি-৪ (শংকরায়িত), বারি-৬ (সিলেকশন-বউ ভোলানি), বারি-৭ (রঙিন-সিলেকশন-আপেল ম্যাংগো), বারি-৮ (সিলেকশন), বারি-৯ (সিলেকশন-কাঁচা মিষ্টি)।
আম থেকে লেবু বিজ্ঞানী
আম গবেষায় একটি উজ্জ্বল তারকার নাম ড. সরফ উদ্দিন। তার হাত ধরে আমের শুধু ব্যাপক বিস্তৃতিই বাড়েনি উপরন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম প্রবেশ করেছে ভৌগোলিক সীমারেখা ছেড়ে বিদেশের রফতানি বাজারে। তিনি গবেষণার হাল ধরেছিলেন ২০০৬ সালে। এরপর ২০১০ থেকে ১৪ পর্যন্ত আমের ওপর উচ্চতর গবেষণা ও পিএইচডি করতে যান চীনে। ফিরে এসে আবারো গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। গবেষণায় তার প্রথম সফলতাটি ছিল আমকে মাছি পোকার দমনে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতির উদ্ভাবন। বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম চাষের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত এই প্রযু্িক্ত বিদেশে আম রফতানির সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিয়েছিল। এ সংক্রান্ত গবেষণাটি সফল হওয়ার পর ২০১৬ সাল থেকে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। এ পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য উপকার হচ্ছে আম চাষে বালাইনাশকের ব্যবহার হ্রাস পায়। প্রায ৯০ ভাগ পর্যন্ত বালাই নাশকের ব্যবহার কমে যায়। যাতে এক দিকে যেমন আম চাষে ঝঁকি হ্রাস পায় অন্য দিকে বাহুল্য খরচ কমে যায়। এরপর তার প্রচেষ্টায় ২০১৫-১৬ তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রথমবারের মতো বিদেশে আম রফতানি শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো রয়েছে। বিখ্যাত খিরসাপাতকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তার হাত ধরেই। বর্তমানে লাংড়া, আশ্বিনা ও হাড়িভাঙ্গা আমের নিবন্ধনে তিনি ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের ১৪টি গুরুত্বপর্ণ আম জাতের জেনোসিক সিকোয়েন্স শনাক্ত করেছেন এবং এদের তথ্য উপাত্ত আমেরিকাভিত্তিক এনসিবিআই সংস্থায় দাখিল করেছেন। জাতগুলো হলোÑ বারি আম ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া ফজলি, আশ্বিনা ও মল্লিকা। এই দালিলিক প্রমাণ জাতগুলোর জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে সহায়ক হবে বলে জানা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে, এই গুণী বিজ্ঞানী ২০১৮ সালে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে বদলি হয়েছেন আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র আকবরপুর মৌলভীবাজারে। আম রফতানিতে সংশ্লিষ্ট একটি মহল চাঁপাইনবাবগঞ্জের চেয়ে অগ্রধিকার দিচ্ছিল মেহেরপুর অঞ্চলের আমকে। এই নিয়ে জোরালো প্রতিবাদই তার জন্য কাল হয়েছিল বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। ফলে অনেকটাই বাধাগ্রস্থ হয়েছে আম নিয়ে চলমান গবেষণা। আম ছেড়ে সেখানে তিনি এখন গবেষণা করেন লেবু নিয়ে। এ বিষয়ে ড. সরফ উদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান সংশ্লিষ্ট একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার অভিমত হচ্ছে আম এমন একটি ফল যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বহুবিধ গবেষণার প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দিয়েই আম উৎপাদন কেন্দ্রিক গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণার ধারাবাহিকতা একবার ব্যাহত হলে গবেষকের মানসিকতা এবং গবেষণাকৃত তথ্য-উপাত্ত দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
থেমে গেছে প্রদর্শনী
আম গবেষণা কেন্দ্রের গৃহীত আম প্রদর্শনী প্রকল্পটি অজ্ঞাত কারণে থেমে গেছে। ভালো জাতের আম সংগ্রহ করে তা গবেষণার মাধ্যমে পরে বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য জাত মুক্তায়ন করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৩ সালে ও ২০০৮ সালে এ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে দু’টি প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৯৩ সালের প্রদর্শনীর মাধ্যমে সংগৃহীত আম থেকে পরে বারি ১, ২ ও ৩ জাত মুক্তায়িত হয়েছিল। ২০০৮ সালের রঙিন জাতের আম প্রদর্শনী থেকে বারি ৭ জাত মুক্তায়িত হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান সারা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য আম জাত রয়েছে। ধারাবাহিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব জাত খুঁজে নিয়ে এসে গবেষণা হলে ব্যক্তি ও দেশ উভয়েই উপকৃত হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/408936/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%AE-%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A6%A3%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0

Read 2305 times

Leave a comment

Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.