ফলের রাজা আম। বিঘার পর বিঘা জমিতে যেমন আম চাষ হয়, তেমনই গ্রামবাংলার গৃহস্থ বাড়িতে একটা আম গাছ থাকেই। কিন্তু এর পরিচর্যা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় কারও গাছে মুকুল আসে তো ফল হয় না, কারও আবার ফল পাকার আগেই আম পড়ে যায়। আসলে ভাল আম পেতে যত্ন নিতে হবে বছরভর।
চারা রোপণ
আমের চারা রোপণের আদর্শ সময় হল বর্ষার আগে বা পরে। শীতের সময় চারা রোপণ না করাই ভাল। চারা লাগানোর জায়গাটা বেছে আড়াই ফুটের গর্ত করে জৈব সার ৪০-৫০ কেজি ও আড়াইশো গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট দিয়ে ভর্তি করে ১৫ দিনের মতো ফেলে রাখুন। চারা লাগানোর তিন-চার দিন আগে গর্তগুলো ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শোধন করে নিতে হবে।
আমের বাগান
বাগান করতে চাইলে আয়তকার, বর্গাকার বা ত্রিভুজাকারে ইউনিট করে গাছগুলি লাগান। বিিভন্ন গাছের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দূরত্বে চারাগাছ লাগানো হয়। যেমন আম্রপালী, মল্লিকার মতো শঙ্কর জাতগুলির ক্ষেত্রে ৫ x ৫ মিটার দূরত্বে লাগালেই হবে। তবে হিমসাগর, ফজলির মতো দেশি জাতের ক্ষেত্রে ৮-১০ মিটার দূরত্বে লাগাতে হবে। কালবৈশাখী থেকে রক্ষা করতে হলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এক সারি দেবদারু, কালোজাম, ঝাউ, শিশু প্রভৃতি গাছ লাগিয়ে দিন।
সার প্রয়োগের পদ্ধতি
প্রথম বছরে গাছ প্রতি ১৬০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ১২৫ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ দিন। ১০ বছরের গাছ হলে ১৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ১২৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। বেশি বয়সের গাছ হলে সারের পরিমাণ বাড়বে না। অণুখাদ্যের অভাবে বোরণ, মলিবডেনাম, জিঙ্ক প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা পেতে প্রতি বছর ৪০-৫০ কেজি জৈব সার দিতে হবে।
আগাছা পরিষ্কার
চারা লাগানোর ১ মাস পর বাগানে হালকা চাষ দিয়ে আগাছা বেছে নিতে হবে এবং ফল সংগ্রহের পর পুরনো বাগানে এক বার চাষ দিতে হবে।
মুকুল ছাঁটাই
কলম গাছে এক-দু’বছরের মধ্যেই মুকুল এলে তা ছেঁটে দিতে হবে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত মুকুল গাছের খাবার নষ্ট করে এবং খুব কমই ফলে পরিণত হয়। ২-৫ শতাংশ হারে (২০-৫০ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ইউরিয়া স্প্রে করলে অতিরিক্ত মুকুল ঝরে পড়ে যায়। অক্সিন, জিব্বারেলিন এবং গাছের বৃদ্ধি নিরোধক হরমোন বাইরে থেকে প্রয়োগ করে ভাল ফল পাওয়া যায়। বৃদ্ধি নিরোধক প্যাক্লোবুট্রাজোল প্রয়োগে প্রতি বছর ভাল ফলন পাওয়া যায়।
রোগ নিয়ন্ত্রণ
ক্ষতরোগ (অ্যানথ্রাকনোজ): এ ক্ষেত্রে পাতা, ডাল ও মুকুলের উপর গা়ঢ় বাদামি এবং পরিণত আমের খোসার উপরে কালো দাগ দেখা যায়। অপরিণত গুটি ঝরে পড়ে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অপরিণত অবস্থায় থায়োফানেট মিথাইল, পরিণত অবস্থায় ট্রাইসাইক্লোজল ১৮%+ ম্যানকোজেব ৬২ % জলে গুলে স্প্রে করুন। ট্রাইসাইক্লোজলে আমের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে।
ডাল শুকিয়ে যাওয়া, আঠা ঝরা: পুরনো গাছে অনেক সময় ডাল শুকিয়ে যায় বা আঠা ঝরে। শুকনো ডালগুলি কেটে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫% ডব্লিউপি-এর পেস্ট কাটা অংশে লেপে দিলে ছত্রাকের আক্রমণ হবে না। আঠা ঝরলে গোটা কাণ্ডে পেস্ট লেপতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণ
কেড়ি পোকা: কচি পাতা কেটে দেয়। বিশেষত নার্সারিতে চারাগাছের খুব ক্ষতি করে। শীত কালে চারাগাছগুলির মাঝের জমিতে চাষ দিতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। কেটে ফেলা পাতা পুড়িয়ে দিতে হবে। কীটনাশক হিসাবে কার্বারিল ৫০% ডব্লিউপি ২.৫ গ্রাম বা কার্টাপ হাইড্রোক্লোরাইড ৫০% এসপি এক গ্রাম প্রতি লিটার জলে স্প্রে করতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকা: অনেক পোকা আমের ত্বক ফুটো করে ভেতরের শাঁস খেয়ে আঁটি পর্যন্ত পৌঁছয়। মরসুমে দু’বার এই আক্রমণ হয়। কাঁচা আমের পরে মটর দানা অবস্থায় ও মার্বেল অবস্থায়। এমনটা হলে আক্রান্ত ফলগুলি একসঙ্গে নষ্ট করতে ডাল-সহ কেটে ফেলতে হবে। কাঁচা আমের মটর দানা অবস্থায় আক্রান্ত হলে নিমঘটিত কীটনাশক (১০ মিলি প্রতি লিটার জলে) অথবা মনোক্রোটোফস ৩৬ ইসি (১.৫ মিলি প্রতি লিটার) প্রয়োগ করুন। অথবা মার্বেল অবস্থায় ডাইক্লোরোভস ৭৬% (এক মিলি/লি), পরিণত ফল অবস্থায় সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি (এক মিলি/লি) জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
ফলের মাছি: স্ত্রী পোকা ফলের ত্বকে ডিম পাড়ে। কীড়া ফলের মধ্যে ঢুকে শাঁসের ক্ষতি করে। পরে কীড়া পূর্ণাঙ্গ মাছিতে পরিণত হলে আম ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে যায়। এর ফলে আমের ত্বকে ফুটো দাগ দেখা যায়। এর হাত থেকে রেহাই পেতে হলে বিষটোপ (২০ মিলি ম্যালাথিয়ন ৫০ % ইসি+২০০ গ্রাম ঝোলাগুড়) বিঘা প্রতি ৫-৬টি ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয়, ফেরোমেন ফাঁদ আম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিঘা প্রতি ২-৩টি করে লাগাতে পারলে। তাহলে আর স্প্রে দিতে হয় না।
এছাড়াও শোষক পোকা, দয়ে পোকার উৎপাত-সহ আরও নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। যে সমস্যাই হোক, কৃষি বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রতিকার জেনে নিলে ভাল।