x 
Empty Product
Sunday, 09 June 2013 18:45

রাজশাহীর গাছে গাছে আমের সমারোহ : চাষীদের মুখে হাসি

Written by 
Rate this item
(0 votes)

 

প্রবাদে আছে আমে ধান, আর তেঁতুলে বান। বলা হয়ে থাকে যে বছর ধান হয়; সেবছর আমও ভালো হয়। ধানের বাম্পার ফলনের সঙ্গে সঙ্গে এবার আমেরও বাম্পার ফলন হচ্ছে। ফলে রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আম চাষ যেসব এলাকায় বেশি হয় সে এলাকার চাষিদের মধ্যে বিরাজ করছে আনন্দ। এরইমধ্যে বাজারে উঠতে শুরু করেছে আম। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে আমকেই সবেচেয়ে সুস্বাদু এবং লোভনীয় ফল বলে মনে করা হয়। আমের কদর প্রাচ্য-পাশ্চত্যের দেশগুলিতেও সমান। আমের অন ইয়ার এবং অফ ইয়ার নামে দুটি শব্দ ব্যাপকভাবে চালু আছে। এবার আমের অন ইয়ার। যে বছর ফলন ভালো হয় তাকে অন ইয়ার বলে এবং যে বছর ফলন ততটা ভালো হয় না তাকে অফ ইয়ার বলা হয়ে থাকে। যদিও কৃষি বিজ্ঞানীরা এ ধারণাকে বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আমের অফ ইয়ার অন ইয়ার বলে কিছু নেই। সবটাই নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। আম একটি অর্থকরী কৃষিপণ্য। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি আম উৎপাদিত হয়। তবে পরিমাণ ও মানের দিক থেকে এগিয়ে আছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। প্রকৃতি ও জলবায়ুগত কারণে এই অঞ্চলে উৎকৃষ্টজাতের আমের ফলন হয়। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলের আমের খ্যাতি দেশজোড়া। শুধু তাই নয়, আমকে কেন্দ্র পর)
করে আবর্তিত হয় এই অঞ্চলের মানুষের জীবনজীবিকা। বিশেষ করে আমের মৌসুমে চাঙ্গা হয়ে উঠে রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনীতি। মৌসুমী কর্মসংস্থান হয় লক্ষাধিক মানুষের। আম মৌসুমে গ্রাম-জনপদ রূপ নেয় উৎসবের। সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুকূল আবহাওয়ায় মৌসুমের শুরুতেই এবার রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের আমবাগানগুলি ব্যাপকভাবে মুকুলিত হয়। ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিছু মুকুল নষ্ট হলেও এখন পর্যন্ত গাছে যে পরিমাণ আম অবশিষ্ট আছে, তাতে আমের বাম্পার ফলন হচ্ছে। চাষিরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন বলে মুকুল রক্ষায় তাদের কার্যকরী পরিচর্যা আমের ভাল ফল দিচ্ছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলে ৪৮ হাজার ৩১৩ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। যা থেকে ৫ লাখ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এবার হেক্টর প্রতি আমের ফলন ধরা হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর চাষিরা প্রতি হেক্টরে আমের ফলন পেয়েছিল ৮ হাজার মেট্রিক টন। সূত্র মতে, রাজশাহী অঞ্চলে মোট আম বাগানের প্রায় অর্ধেকই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। এ জেলায় ২৪ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। এই পরিমাণ বাগান থেকে এ বছর ২ লাখ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। অন্যদিকে রাজশাহী জেলায় ৮ হাজার ৬৬৭ হেক্টর বাগান থেকে উৎপাদন ধরা হয়েছে ৯০ হাজার ৩৫০ মেট্রিকটন। অন্যদিকে নওগাঁ জেলায় ৪ হাজার ৮২৫ হেক্টর বাগানে ৭৭ হাজার ২০০ মেট্রিকটন, নাটোর জেলায় ৩ হাজার ৭০০ হেক্টরে ৪২ হাজার ৮৪৬ মেট্রিকটন, বগুড়ায় ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টরে ৩১ হাজার ২৩০ টন, জয়পুরহাটে ৬২২ হেক্টর বাগানে ৪ হাজার ১৩৬ টন, পাবনা জেলায় ১ হাজার ৯০৪ হেক্টর জমিতে ১৫ হাজার ৩৭৮ টন এবং সিরাজগঞ্জে ২ হাজার ৫৫ হেক্টর জমির আম বাগানে ২০ হাজার সাড়ে ৫০০ টন আম হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমের ফলন হয়। এসব জেলার আমও জাতীয় উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক অসীম কুমার পাল জানান, এবার রাজশাহী অঞ্চলে আমের ফলন ভালো হবে। কয়েকদিন পরেই রাজশাহী অঞ্চলের আম বাজারে আসবে। আমকেন্দ্রিক বাণিজ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের অর্থনীতি। তিনি আরও বলেন, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই মাঝেমাঝে বৃষ্টিপাত হওয়ায় আম পুষ্ট হয়েছে। ফলে আমের স্বাদও ভালো হবে। পুষ্ট হওয়ায় আমের মোট ফলনও বাড়বে। সেইসঙ্গে আম নষ্ট হবে কম, পুষ্টিগুণও বেশি পাবে ভোক্তা। প্রায় আড়াইশ জাতের আম উৎপন্ন হয় রাজশাহী অঞ্চলে। এগুলোর বেশিরভাগই দেশী বা স্থানীয় জাতের। তবে কিছু কিছু হাইব্রিড জাতের আমও এখন স্থান করে নিয়েছে রাজশাহী অঞ্চলের বাগানগুলিতে। তবে ফজলিকে আমের রাজা বলা হলেও স্থানীয় জাতের ল্যাংড়া, গোপালভোগ ও ক্ষিরসাপাত আম স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। এসব আমের দামও বেশি। এসব জাতের আম স্বল্পসময়ে বাজারে আসে আবার দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। এছাড়াও বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, গুটি, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লখনা ও মোহনভোগ জাতের আম বেশি হয় এই অঞ্চলে। রাজশাহী অঞ্চলের গাছে গাছে বাহারি জাতের আম এখন দেশের মানুষের রসনা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছে। আমচাষিদের মনে এখনই উঁকি দিচ্ছে মুনাফার আগাম বার্তা। কয়েকদিন পরেই রাজশাহী অঞ্চলের মোকামগুলি আমে সয়লাব হয়ে যাবে। আমযজ্ঞে মেতে উঠবে হাজার হাজার মানুষ। চাষিরা বাগান থেকে আম নামিয়ে আনবেন মোকামে। সেখান থেকে ব্যাপারিরা কিনে বিভিন্ন যানবাহনে পাঠাবেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারে মে মাসের শেষ দিকে আগামজাতের আমগুলি বাজারে উঠবে। প্রথমে আসবে গোপালভোগ ও রানীপছন্দ। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই লখনা, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, দুধসর, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আম বাজারে আসবে। মৌসুমের শেষে ফজলি এবং সবশেষ বাজারে উঠবে আশ্বিনাজাতের আম। আম শেষ হবে জুলাই মাসের শেষদিকে। পুরো তিনমাসে শত শত কোটি টাকার আম বাণিজ্য হবে। এই বাণিজ্যেই সারাবছর চাঙ্গা থাকবে এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি। দেশে আমের দুটি বড় মোকাম রয়েছে। একটি রাজশাহীর বানেশ্বর অন্যটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট। এ দুটি মোকাম থেকে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ট্রাক আম চালান হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। কখনও হয় আরও বেশি। হাজারো মানুষ এসব কাজে নিয়োজিত থাকেন। দিনরাত চলে এই কাজ। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারিরা পুরো তিন মাসই এ দুটি মোকামে অবস্থান করেন। কুমিল্লার বুড়িচং এর শহীদুল্লাহ ব্যাপারি জানালেন, ঢাকার বাদামতলী হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ফলের বাজার। বিভিন্ন স্থান থেকে আম এনে জড়ো করা হয় এখানে। এখান থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আম নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন ঢাকা ও শহরতলীতে। আশপাশের জেলাতেও আম যায় এখান থেকে। এছাড়া চট্টগ্রাম, ফেনী, সিলেট ও কুমিল্লাও আমের বড় বাজার। সারাদেশের ব্যাপারিরা এসব বাজারে আম নিয়ে হাজির হন বিক্রির জন্য। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ঢাকার ভোক্তারা তাজা ও টাটকা আম খাওয়ার সুযোগ পান। আবার এসব আমের দামও ভাল পান চাষিরা। দেশে বিপুল পরিমাণ আম উৎপাদিত হলেও সিংহভাগই সরাসরি ভোগ করেন ভোক্তারা। আমকেন্দ্রিক শিল্পের কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও তা সামান্যই। রাজশাহী অঞ্চলের আমের বিপুল চাহিদা রয়েছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু উপযোগী নীতিমালার অভাবে আম রপ্তানি করা যায় না। আম থেকে উন্নতমানের আচার, সস, জেলি, জুসসহ মুখরোচক খাদ্যপণ্য তৈরি সম্ভব। জানা যায়, নাটোরে প্রাণ গ্রুপ একটি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুললেও সেখানে উপাদিত আমের সামান্য অংশই কাজে লাগানো হয়। জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র থেকে পাঠানো আমের নমুনা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতে দুবছর আগে গৃহীত হলেও বিদেশের বিশাল বাজার ধরতে পারছে না এই অঞ্চলের আম ব্যবসায়ীরা। উদ্যোগ নেই সরকারিভাবেও।

উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে বিপুল পরিমাণ আম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশে উপহার হিসেবে পাঠানো ছাড়া কখনই রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রতি বছর ৪১ হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করে। এমনকি পাকিস্তানও প্রতি বছর গড়ে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন আম বিদেশে পাঠায়। ভারত ও পাকিস্তানের মত বাংলাদেশে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকারি কৃষিজ উৎপাদন রপ্তানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হরটেক্স ফাউন্ডেশন একাধিকার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়। ২০১০ সালের ৩০ জুন হরটেক্স ফাউন্ডেশন চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যানতত্ত্ব কেন্দ্র উদ্ভাবিত বারি-২ জাতের আমের নমুনা পাঠিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে। নমুনা পাঠানোর মাত্র দুসপ্তাহের মাথায় ১২ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এক ফ্যাক্সবার্তার মাধ্যমে জানানো হয়, উৎকৃষ্টমানের এই আমের নমুনা তাদের খুব পছন্দ। কিন্তু এরপর দুবছর অতিবাহিত হলেও এবিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি নেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যান গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় বিদেশে আম রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, এসব সমস্যার সমাধান হলে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভবান হবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সত্রাজিতপুর গ্রামের আদর্শ আম চাষি হারুনুর রশীদ বলেন, আম এই জেলার মানুষের জীবনজীবিকার প্রধান অবলম্বন। আমবাগান বিক্রি করেই হাজার হাজার পরিবার চলে। জাতীয় অর্থনীতিতেও আমের ভুমিকা আছে। কিন্তু আম চাষিদের জন্য সরকারি কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চাষিরা প্রাচীন পদ্ধতিতে আম চাষ করেন। এজন্য তারা আমের ফলন কম পান। ফড়িয়া ব্যাপারিরাই আমের সবটুকু লাভ তুলে নিয়ে যান। কৃষি বিভাগ আমের ফলন হিসাব করা ছাড়া আর কোন কাজ করে না।

কানসাটের আমচাষি মাহাতাবউদ্দিন বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ না করা, যুগপোযোগী প্যাকিং ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থার অভাবে আম রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা। অথচ বাংলাদেশ থেকে ফজলি, হিমসাগর, বারি-২, ল্যাংড়া, বারি-৭ জাতের আম বিপুল পরিমাণে রপ্তানি করা সম্ভব। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিওসার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, বিদেশে আম রপ্তানির বিষয়টি মাথায় রেখে তারা আম চাষি ও এর সাথে সংশ্লিষ্টদের সভা-সেমিনার করে সচেতন করার চেষ্টা করছেন।

Read 4012 times Last modified on Tuesday, 03 September 2013 04:46

Leave a comment

Make sure you enter the (*) required information where indicated. HTML code is not allowed.