বইছে ফাগুনের হাওয়া। আমের গাছের গাছে মুকুল। সে মুকুল সুবাস ছড়াচ্ছে চারদিকে। দু’একটি মুকুল থেকে মটরদানার মতো বেরিয়ে আসছে আমের গুটি। সেগুলো টিকিয়ে রাখতে এমনিতেই পরিচর্যা কম করছেন না চাষিরা। তার ওপরে এরই মধ্যে আকাশ থেকে ঝরলো বৃষ্টি।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপক্ষে নয়; আমের ভালো ফলনের পক্ষেই আছে এই বৃষ্টি। দিনের পর দিন গাছের গোড়ায় পানি ঢেলেও যে লাভ না হতো তার চেয়েও বেশি লাভ হয়েছে বৃষ্টিতে। বৃষ্টির কারণে আমের গুটি আকারে বড় হবে, ফলনও হবে বেশি। তাই আমে এবার অন্য বছরের চেয়ে ভালো লাভের আশা করাই যায়।
রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, বৃষ্টিতে আমের গাছের পাতার ওপর থেকে ধুলা-ময়লা ধুয়ে গেছে। এতে পাতার মাধ্যমে মুকুলগুলো বেশি পরিমাণে সূর্যালোক থেকে খাদ্য গ্রহণ করবে। এ কারণে গুটির ঝরেপড়া যেমন রোধ হবে তেমনি আকারও হবে বড়। তাছাড়া বৃষ্টির পরদিন পর্যাপ্ত রোদ হওয়ায় মুকুলের ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গগুলো মারা যাবে। ফলে এবার আমের উৎপাদন ভালো হবে বলে আশা করা যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালিও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এবার গাছে যখন মুকুল আসা শুরু হয় তখন শীত ছিল। আবার শেষের দিকে গরমও পড়তে শুরু করেছিল। তাই গেল কয়েক বছরের তুলনায় এবার গাছে সবচেয়ে বেশি মুকুল এসেছে। তাই আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে রাজশাহীতে এবার সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানায়, জেলায় প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টর জমির আম বাগান থেকে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। সে অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমে রাজশাহীতে সাধারণত এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। কিন্তু এবার কালবৈশাখী কম হলে আমের উৎপাদন এর চেয়েও বেশি আশা করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন বলেও আশা কৃষি বিভাগের।
জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার বিজয়নগর গ্রামের আমচাষি আবদুর রউফ বলেন, গাছে মুকুল থাকা অবস্থায় গত রোববার রাতে বৃষ্টি হলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। মনে করেন, বৃষ্টিতে আমের মুকুল ঝরতে শুরু করবে। তাই পরামর্শ নিতে তিনি ছুটে যান কৃষি অফিসে। সেখানে তাকে আশ্বস্ত করা হয়, বৃষ্টিতে ক্ষতি নয়; লাভই হয়েছে আমের মুকুলের। এখন বাগানের গাছগুলোতে যেভাবে মুকুল রয়েছে তা দেখে তিনি অধিক লাভের আশা করছেন।
তবে উৎপাদনের পর আমের দাম কেমন থাকে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন কোনো কোনো চাষি। গত মৌসুমে বাজারজাত করণে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনেও ভয় পাচ্ছেন অনেক চাষি। এ অবস্থায় পরামর্শের জন্য চাষিদের কৃষি দপ্তরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপে আম রপ্তানির আশায় গত মৌসুমে জেলার প্রায় শতাধিক চাষি ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধাতিতে আম চাষ করেছিলেন। কিন্তু এসব চাষির অধিকাংশই স্থানীয় বাজারে আম বিক্রি করেন। অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের এই আম স্থানীয় বাজারে বিক্রি করায় ক্ষতি না হলেও খুব বেশি লাভও হয়নি।
কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছর ফ্রুট ব্যাগের ব্যবসা করতেই একটা মহল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তাই প্রায় তিন কোটি ফ্রুট ব্যাগ বিক্রি হয়েছিল। চাষিরা ভেবেছিলেন, শুধু ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম চাষ করলেই বিদেশে রপ্তানি হবে। কিন্তু এটি সঠিক নয়। বিদেশে রপ্তানি করতে হলে মৌসুমের শুরুতেই চাষি ও রপ্তানিকারকের মধ্যে চুক্তি হতে হয়। চুক্তিতে দামসহ বেশকিছু বিষয় উল্লেখ থাকে।
দামের বিষয়টা ঠিক করে দেয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এই চুক্তিতে আম চাষের পদ্ধতি ও গুণগত মানের কথাও উল্লেখ থাকে। এই বিষয়গুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা যাচাই করে কৃষি বিভাগ। সবকিছু ঠিক থাকলেই চাষির আম যায় বিদেশে। কিন্তু গত বছর ফ্রুট ব্যাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্ররোচনায় পড়ে এসব নিয়মকানুন না মেনেই আম উৎপাদন করেছিলেন চাষিরা। ফলে তাদের আম যায়নি বিদেশ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক জানান, এ বছর এখন পর্যন্ত শুধু জেলার বাঘা উপজেলার ২২ জন চাষি আম রপ্তানির করতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। কৃষি বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক তারা রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করবেন।
দেশের বাইরে আম রপ্তানি করতে চাইলে এখনই চাষিদের কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।